পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ১৬ অক্টোবর, ইসলামাবাদ
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। ১৬ অক্টোবর, ইসলামাবাদ

ক্রিকেটের হাত ধরে কি ভারত–পাকিস্তানের সম্পর্ক আবার উষ্ণ হবে

ভারত–পাকিস্তানের সম্পর্কের জমাট বাঁধা বরফ তবে কি ক্রিকেটের হাত ধরে গলতে শুরু করবে? আলোচনার স্তরে বিষয়টি উঠে এসেছে ৯ বছর পর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দুই দিনের পাকিস্তান সফরকে কেন্দ্র করে। সাংহাই কো–অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে জয়শঙ্কর গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদে গিয়েছিলেন। গতকাল বুধবার তিনি দেশে ফিরেছেন।

ইসলামাবাদে সর্বশেষ ২০১৫ সালে সফরে যান ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তারপর গেলেন জয়শঙ্কর। এই সফরে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা যে হবে না, শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে যাওয়ার আগেই তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন জয়শঙ্কর। ফলে পাকিস্তানি নেতৃত্বের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকও তাঁর হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে জয়শঙ্করের একাধিকবার দেখা হয়েছে। কুশল বিনিময় হয়েছে।

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মদ ইশাক দারের সঙ্গেও অন্তত দুবার কথা হয়েছে জয়শঙ্করের। একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ মোহসিন রাজা নাকভিও সামান্য সময়ের জন্য হাজির হয়েছিলেন। নাকভি পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডেরও চেয়ারম্যান।

এসসিও সম্মেলন কভার করতে ইসলামাবাদে যাওয়া ভারতীয় সাংবাদিকেরা কূটনৈতিক সূত্রে পাওয়া খবরের ওপর নির্ভর করে তাঁদের প্রতিবেদনে যা লিখেছেন, তা ‘ক্রিকেট ডিপ্লোমেসি’র প্রতিই ইঙ্গিত করছে। তাঁদের প্রতিবেদনের নির্যাস, পাকিস্তান মনেপ্রাণে চাইছে আগামী বছর চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলতে ভারতীয় ক্রিকেটারেরা যেন পাকিস্তানে যান। সে জন্য ভারতের সব চাহিদা মেনে নিতে পাকিস্তান প্রস্তুত।

আগামী বছরের ১৯ থেকে ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ চ্যাম্পিয়নস ট্রফির একদিনের ক্রিকেট প্রতিযোগিতার আসর বসবে পাকিস্তানে। দীর্ঘ ১৭ বছর ভারতীয় ক্রিকেট দল পাকিস্তানে যায়নি। শেহবাজ শরিফের সরকার তা ভাঙতে আগ্রহী।

অবশ্য প্রতিবেদনগুলোয় এ কথাও বারবার লেখা হয়েছে, জয়শঙ্করের সঙ্গে এ বিষয়ে যা কথা হয়েছে, তা একেবারেই প্রাথমিক স্তরে। তবে সেই সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতায় ক্রিকেটপ্রেমী জয়শঙ্কর এমন কোনো ইঙ্গিত দেননি, যাতে ভারতের অনাগ্রহ প্রকাশ পায়। বরং বহু বছর পর এই প্রথম দুই দেশের নেতাদের ইতিবাচক মনোভাবের পরিচয়ই এই সম্মেলনের আসরে পাওয়া গেছে। পারস্পরিক আচরণেও তা ফুটে উঠেছে।

গত বছর এসসিও সম্মেলনের আসর বসেছিল ভারতের গোয়ায়। তাতে যোগ দিয়েছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি। ভারতে বসে তিনি কাশ্মীর পরিস্থিতির সমালোচনা করেছিলেন। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। ভারতকে তা ক্ষুব্ধ করেছিল। বিলাওয়ালকে জয়শঙ্কর ‘সন্ত্রাসবাদ শিল্পের মুখপাত্র’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

সেই তুলনায় এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। জয়শঙ্কর চাইলেই গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শরিফের দেওয়া নৈশভোজ এড়াতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। বরং যোগ দিয়েছেন। পাকিস্তানের কেউ প্ররোচনামূলক কোনো মন্তব্যও করেনি। সে দেশের যোজনামন্ত্রী আহসান ইকবাল ‘লাহোর ঘোষণাপত্র’ অনুসরণের ওপর জোর দিয়েছেন।

তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার বলেছেন, এটা বহুপক্ষীয় সম্মেলন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জয়শঙ্করকে ‘পাকিস্তানের মেহমান’ বা অতিথি বলে বর্ণনা করেছেন তিনি। জয়শঙ্কর তাঁর ভাষণে সন্ত্রাসবাদ, চরমপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদকে ‘তিন অশুভ শক্তি’ বলে জানিয়েছেন। বলেছেন, প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতা তখনই সম্ভব, যখন পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সার্বভৌমত্বের সাম্যতা থাকে। তিনিও কোনো কটু মন্তব্য করেননি। বরং চলে আসার আগে জানিয়েছেন, ‘ইসলামাবাদ ছেড়ে যাচ্ছি। আতিথেয়তা ও সৌজন্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী, উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং পাকিস্তান সরকারকে ধন্যবাদ।’

প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া নৈশভোজের আসরেই ইশাক দারের সঙ্গে জয়শঙ্করের প্রথম কথা হয়। পর দিন গতকাল পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের পর মধ্যাহ্নভোজে জয়শঙ্করের পাশেই বসেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যাতে আগের রাতে হওয়া কথাবার্তার রেশ ধরে আরও কিছু আলোচনা করা যায়।

দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস লিখেছে, মধ্যাহ্নভোজে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশাপাশি বসার কথা ছিল না। কিন্তু প্রটোকলকে তেমনভাবেই আসন পাতার নির্দেশ পাকিস্তানের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। নৈশভোজ ও মধ্যাহ্নভোজের পর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলোচনার সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন রাজা নাকভিকেও দেখা গিয়েছে। ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান বলে নাকভির আগ্রহ কারও চেয়ে কম নয়।

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইশাক দারের গুরুত্ব খুব। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ঘনিষ্ঠই শুধু নন, দুই পরিবার বিবাহ সূত্রে একে অন্যের আত্মীয়।

ওয়াকিবহাল মহলের খবর অনুযায়ী, পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড ভারতের বিসিসিআইকে প্রস্তাব দিয়েছে, লিগ পর্যায়ের তিনটি ম্যাচ তারা লাহোরে রাখতে রাজি, যাতে ভারত চাইলে ম্যাচ শেষে দিল্লি ফিরে যেতে পারে। ভারতীয় ক্রিকেট দল যাতে পাকিস্তানে যায়, সে জন্য শরিক সরকার কতটা মরিয়া এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে।

কিন্তু ভারত কী করবে। কূটনৈতিক মহল বলছে, সেই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি রাজনৈতিক। পাকিস্তানে যেতে না চাইলে ভারতের খেলাগুলো তৃতীয় কোনো দেশে দেওয়া হবে। শেষ বার এশিয়া কাপও হয়েছিল এভাবেই।

ইংল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) চেয়ারম্যান রিচার্ড টমসন এই মুহূর্তে রয়েছেন পাকিস্তানে। গতকাল তিনি বলেছেন, ভারত চ্যাস্পিয়নস ট্রফি না খেললে ক্রিকেটের ক্ষতি। ভারত ছাড়া চ্যম্পিয়ান্স ট্রফি হওয়াও সম্ভব নয়। টমসন মনে করেন, বিসিসিআইয়ের সাবেক সচিব ও আইসিসির নতুন চেয়ারম্যান জয় শাহর ওপর (ডিসেম্বরে দায়িত্ব নেবেন) অনেক কিছু নির্ভর করছে। জয় শাহর বাবা ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।

বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ভারত–পাকিস্তান ক্রিকেট সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। জানতে চাওয়া হয়, জয়শঙ্করের পাকিস্তান সফরের সময় ভারতীয় ক্রিকেট দলের পাকিস্তানে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের অভিমত নিয়ে প্রশ্ন করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল প্রথমে বলেন, ‘তেমন কিছুই নয়।’ তারপর বলেন, ‘এ বিষয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট পুরোপুরি নির্ভুল নয়।’

ক্রিকেটের হাত ধরে জমাটবাঁধা বরফ গলতে শুরু করলে পাকিস্তান–ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচিত হতে পারে। দুই দেশের মধ্যে সামগ্রিক আলোচনা বা ‘কম্প্রিহেনসিভ ডায়লগ’ গত ১০ বছর ধরে বন্ধ।