ভারতের সাফল্য তুলে ধরতে কলম ধরলেন মোদি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
 ছবি: এএনআই

চিরায়ত গতানুগতিক প্রথা ও রীতিনীতির বাইরে বেরিয়ে জি-২০ সম্মেলনকে ভারত কীভাবে গরিব ও অনুন্নত দেশগুলোর আলোকবর্তিকা করে তুলেছে, তা বোঝাতে কলম ধরলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সঙ্গেই সুর মিলিয়েছেন দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। চীন ও রাশিয়ার দুই প্রেসিডেন্ট সম্মেলনে যোগ না দিলেও এক বছর ধরে ভারত কীভাবে এই সম্মেলনের সার্থকতার নির্যাস সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করের কলমে তা উঠে এসেছে। ভারতের অধিকাংশ বড় সংবাদপত্রে মোদির এই নিবন্ধ আজ বৃহস্পতিবার ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।

কোভিড ১৯–পরবর্তী চ্যালেঞ্জের সার্থক মোকাবিলায় কী কী করণীয়, সে বিষয়ে মোদি অনেক দিন ধরেই তাঁর ভাবনাচিন্তার কথা বিশ্বকে শুনিয়ে আসছেন। এই নিবন্ধেও তা লেখার মধ্য দিয়ে তিনি সম্ভবত চাইছেন সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে তা লিপিবদ্ধ করাতে।

মোদি তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর কথায়, উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানোই শেষ কথা নয়, মানবিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হন। প্রবৃদ্ধিভিত্তিক (জিডিপি) দৃষ্টিভঙ্গি ছেড়ে মানবকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যেতে হবে। সারা পৃথিবী ক্রমেই তা উপলব্ধি করছে। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক সরবরাহের ক্ষেত্র (গ্লোবাল সাপ্লাইচেইন) স্থিতিশীল ও নির্ভরযোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে অনুন্নত দেশের মানুষজনকে দুর্দশার মধ্যে পড়তে না হয়। তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সংস্কার করে বহুপক্ষীয়তার প্রসার ঘটানো। তিনি লিখেছেন, এই তিন ক্ষেত্রের পরিবর্তনে জি-২০-তে ভারতের সভাপতিত্ব অনুঘটকের কাজ করেছে।

সি ও পুতিনের গরহাজিরা সেই লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা। আর তা সামাল দেওয়াই মোদির এই নিবন্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে বিরোধীদের ধারণা।

মোদি বলেছেন, শুরু থেকেই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে ভারত সচেষ্ট থেকেছে। উন্নয়নশীল দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলোর পাশাপাশি আফ্রিকার প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকে মূল ধারায় আনতে এর প্রয়োজন ছিল। সেই কারণে আফ্রিকান ইউনিয়নকে এই জোটের স্থায়ী সদস্য করার ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।

জি-২০ সম্মেলন ঘিরে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিকে সাজানো হচ্ছে

মোদির এই নিবন্ধ প্রকাশিত হলো সেই সময়, যখন সবাই জেনে গেছে শীর্ষ সম্মেলনে রাশিয়া ও চীনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও সি চিন পিং জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন না। এ কথাও যখন পরিষ্কার যে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা ব্লক চাইলেও ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধাচরণ করে কোনো প্রস্তাব গ্রহণের সম্ভাবনা নেই। যুদ্ধের নিন্দাজনক সর্বগ্রাহ্য কোনো যৌথ ঘোষণাপত্রও গৃহীত হবে না। জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠকেও যৌথ ঘোষণাপত্র প্রকাশিত হয়নি। অনৈক্যের এই স্পষ্ট ছবি শীর্ষ সম্মেলনে যাতে প্রাধান্য না পায়, সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বলিখিত নিবন্ধের মাধ্যমে জোটের ইতিবাচক দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। শুধু তা–ই নয়, পছন্দের গণমাধ্যমে ঠিক এই সময়ে তিনি একাধিক সাক্ষাৎকারও দিয়েছেন। এক বছরে কীভাবে কোনো একটি মাত্র শহরে এই গোষ্ঠীকে আবদ্ধ না রেখে সর্বজনীন করে তুলতে হয়, তা বোঝাতে চেয়েছেন।

সম্মেলনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক এলাকায় ড্রোন প্রতিরোধী ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে ভারত

কিন্তু তা ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে জি-২০-এর অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সেই রাজনৈতিক অক্ষের এক দিকে রাশিয়া ও চীনের অবস্থান, অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্রদেশের। মোদি ভারত সভাপতি হিসেবে এই দুই প্রান্তের মধ্যে ভারসাম্যের খেলা খেলতে চেয়েছেন গোটা বছর ধরে। কিন্তু সাফল্য ছিটেফোঁটা। ইউক্রেনের যুদ্ধ সমাপ্তির চিহ্নমাত্র দৃশ্যমান না হওয়া মোদির নেতৃত্বের ব্যর্থতার পরিচায়ক। পুতিনকে তিনি যতই বলুন ‘এটা যুদ্ধের যুগ নয়’, যুদ্ধাবসানের কোনো সফল উদ্যোগ তিনি নিতে পারেননি।

এর আগে দুটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করলেও কংগ্রেস নিজেদের প্রচারের অঙ্গ হিসেবে কখনো তুলে ধরেনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদি স্রেফ নিজের ঢাক পিটিয়ে চলেছেন।
জয়রাম রমেশ, মুখপাত্র, কংগ্রেস।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের শীতলতাও বেড়েছে বই কমেনি। বেড়েছে বলেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ভারতে আসার আগে সে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান চীনকে গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। ভূকৌশলগত স্বার্থসিদ্ধির বদলে আন্তর্জাতিক সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কও দক্ষিণমুখী। পূর্ব লাদাখের গালওয়ান সংঘর্ষের পর থেকে সম্পর্কের অবনমন ঘটেই চলেছে। তিন বছর ধরে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) স্থিতাবস্থা বজায় রাখার ভারতীয় দাবিকে চীন আমল দিচ্ছে না। শীর্ষ সম্মেলনেও সি চিন পিং না আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। আর সেটা করা হলো সম্মেলনের ঠিক আগে আকসাই চীন ও অরুণাচল প্রদেশকে চীনের অন্তর্ভুক্ত করে মানচিত্র প্রকাশের পর।

মোদির ভাবমূর্তি গড়তে কলাম লিখেছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করও

ভারতের নেপাল নীতি নিয়েও চীন মুখর। নেপালে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত চেন সং কদিন আগেই সমালোচনা করে বলেছেন, নেপালসহ অন্য প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের নীতি সব সময় বন্ধুত্বপূর্ণ নয়, পারস্পরিক লাভজনকও নয়। প্রতিবেশীদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশ। শীর্ষ সম্মেলনের ঠিক আগে এ ধরনের মন্তব্য ভারতের পক্ষে অবশ্যই হতাশাজনক। সবচেয়ে বড় কথা, নির্বাচনের প্রাক্কালে চীনের দিক থেকে এমন রেষারেষি মোদির দল বিজেপির পক্ষে ভালো নয়। এ নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী কণ্ঠস্বরও জোরালো হচ্ছে। তার মোকাবিলাতেই প্রধানমন্ত্রী জি-২০-এর সভাপতি হিসেবে ভারতের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরলেন বলে রাজনৈতিক ধারণা।

কিন্তু ভোট আবহে দেশি রাজনীতিতে জি-২০কে সরকার যতই তুলে ধরতে চাক, সাধারণ মানুষের কাছে তা অনুরণন তুলতে পারেনি। তীব্র মূল্যবৃদ্ধি, প্রবল বেকারত্ব, সামাজিক বিভাজন, দুর্নীতির অভিযোগ, মণিপুর সংকট, ঘৃণা ভাষণ ও সাম্প্রদায়িকতাসহ বিভিন্ন বিষয় বিরোধীরা প্রতিদিন নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার দাবিও জানিয়ে রেখেছে। এর বিপ্রতীপে জি-২০–এর মাধ্যমে ‘বিদেশে দেশের ছবি উজ্জ্বল করে তোলা’ নরেন্দ্র মোদির ‘বিশ্বগুরু’তে রূপান্তর হওয়াকে বিজেপি বড় করে তুলে ধরতে চাইছে। সি ও পুতিনের গরহাজিরা সেই লক্ষ্য পূরণের ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা। আর তা সামাল দেওয়াই মোদির এই নিবন্ধের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য বলে বিরোধীদের ধারণা।

সফল বিশ্বনেতা হিসেবে মোদির ভাবমূর্তি গড়তে দল হিসেবে বিজেপি ছাড়াও মন্ত্রিসভার বিভিন্ন সদস্য প্রচারে নেমেছেন। যেমন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, বছরজুড়ে সারা দেশে যা হলো, তা ‘মানুষের আন্দোলন’। মোদির সঙ্গে একই দিনে বহুল প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকে বৃহস্পতিবার তিনি নিবন্ধ লিখে বলেছেন, ‘একদা যা ছিল রাজধানী দিল্লির বিজ্ঞান ভবন ও লুটিয়েন্স দিল্লিতে সীমাবদ্ধ, মোদি তা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে দেশবাসীকে অংশীদার করে তুলেছেন। এটাই গণতান্ত্রিক মানসিকতা। একটি মাত্র শহর সব নিয়ন্ত্রণ করবে সেই দিন আর নেই।’

জি-২০–কে গণ–আন্দোলনে পরিণত করার কথা জয়শঙ্করের মতো মোদিও লিখেছেন। দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ৬০টি শহরে এই এক বছরে ২০০টির বেশি বৈঠকে ১২৫টি দেশের ১ লাখ প্রতিনিধির যোগদানের কথা বলে তিনি লিখেছেন, বড় আকারে কোনো কাজ করার কথা ভাবতে গেলে ভারতের নাম প্রথমেই মনে আসবে। এত বিপুল ও ভৌগোলিক বৈচিত্র্যপূর্ণ আয়োজন এর আগে কোনো দেশ করেনি।

বিরোধীদের অভিযোগ জি-২০ সম্মেলন ঘিরে নরেন্দ্র মোদি নিজের ঢাক পিটিয়ে চলেছেন

সেই রাজসূয় যজ্ঞ কিসের বিনিময়ে? কেন্দ্রীয় বাজেটে এই খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৯৯০ কোটি রুপি। এর বাইরে দিল্লি পুলিশ, নয়াদিল্লি পৌরসভা, পূর্ত বিভাগ, পরিবহন বিভাগ, সড়ক বিভাগ, দিল্লি উন্নয়ন পর্ষদ ও বন বিভাগের সম্মিলিত খরচ আরও ১১০ কোটি রুপি। কেন্দ্রীয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ভারতের ট্রেড প্রমোশন সংস্থা (আইটিপিও) খরচ করেছে ৩ হাজার ৬০০ কোটি রুপি, যা প্রধানত ব্যয় হয়েছে পুরোনো প্রগতি ময়দান ঢেলে সাজাতে। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে সম্মেলনের মূল মন্ডপসহ ‘ভারত মন্ডপম’ বিভিন্ন স্থাপনা। দেশের ২৮ রাজ্য ও ৮ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বছরভর সম্মেলনের কোনো না কোনো বৈঠক আয়োজনে রাজ্য সরকারের খরচের মধ্যে ধরা হয়নি।

বিনিময়ে প্রাপ্য? কংগ্রেসের অভিযোগ, প্রাপ্য বলতে লাভবান শুধু একজন ব্যক্তি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১৯৮৩ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী একই বছরে জোট নিরপেক্ষ ও কমনওয়েলথ দেশসমূহের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। সেই কথা উল্লেখ করে কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেছেন, ‘সেই দুই সম্মেলনকে কংগ্রেস নিজেদের প্রচারের অঙ্গ হিসেবে কখনো তুলে ধরেনি। অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদি স্রেফ নিজের ঢাক পিটিয়ে চলেছেন!’

এই রাজনৈতিক চাপান–উতোরের মধ্যেই দিল্লি সেজেগুজে প্রস্তুত জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত রাষ্ট্রীয় নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনের জন্য।