ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের অন্ধ্র প্রদেশ রাজ্যের আনন্দপুর গ্রামের কৃষক মালাপ্পা। ২০১৮ সালের ৯ আগস্ট মালাপ্পা কিছু জিনিস কেনার কথা বলে ঘর ছেড়ে চলে যান। পরদিন সকালে জমিতে মালাপ্পার লাশ পাওয়া যায়। অভাব আর সংসারের চাপ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন দরিদ্র এই কৃষক। নিজের শেষকৃত্যের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামও কিনে রেখে যান।
মৃত বাবার উদ্দেশে চিঠি লিখেছেন মালাপ্পার আদরের ছোট মেয়ে লক্ষ্মী। তাঁর বয়স এখন ২৫ বছর। ভারতের সরকারের কাছে কয়েকটি প্রশ্ন রেখেছেন লক্ষ্মী। জানতে চেয়েছেন, কেন তাঁর বাবাকে এমনভাবে চলে যেতে হলো?
মালাপ্পার কষ্ট বুঝতে হলে তাকাতে হবে পেছনে। মালাপ্পা নিজের এক টুকরো জমিতে চাষাবাদ করে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণ করাতেন। ধনী না হলেও ঘরে খুব অভাব ছিল না।
ছোট মেয়েটিকে নিয়ে তাই বাবা স্বপ্ন বুনেছিলেন। অন্য ছেলেমেয়েরা আর স্ত্রী জমিতে কাজ করতেন। মালাপ্পা ছোট মেয়েকে জমিতে যেতে দিতেন না। চেয়েছিলেন মেয়ে পড়াশোনা করবে, চাকরি করবে। ছোট মেয়েটি অন্য ভাইবোনদের চেয়ে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল ছিল। তাই বাবার আদর–সোহাগও যেন কিছুটা বেশি পেত। উৎসবে, পালাপার্বণে অন্য ভাইবোনেরা খরচের জন্য হিসাব করা অর্থ পেত। মালাপ্পা তাঁর মেয়েকে আলাদা কোনো খরচ দিতেন না। মেয়েকে ঘাড়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। মেয়ে বাবার কাছে টুকটাক যা আবদার করত, কিনে দিতেন দুই হাত খুলে।
ছোট ছোট এই সুখগুলো নিয়ে কেটে যাচ্ছিল কৃষক মালাপ্পা আর তাঁর পরিবারের জীবন। সংসারের খরচ দিন দিন বাড়ছিল। সংসার চালাতে গিয়ে মালাপ্পা হাঁপিয়ে উঠতেন। তবে কাউকে বুঝতে দিতেন না। ছোট্ট মেয়েটি হয়তো কিছুটা বুঝত বাবার কষ্ট।
তাই তো মৃত বাবাকে চিঠি লিখেছেন লক্ষ্মী। বাবার মৃত্যু ঘিরে মনের মধ্যে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজেছেন।
চিঠির শুরুতে লক্ষ্মী বলেছেন, ‘আব্বা, আমি তোমার ছোট মেয়ে। আমার বয়স এখন ২৫ বছর। তুমি আমাদের ছেড়ে চলে গেছ। তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ে। মনে পড়ে যখন আমার বয়স ৫ বছর, তুমি আমাকে জমিতে নিয়ে আসতে। তোমার হাত ধরে হাঁটতে আমার কী যে ভালো লাগত। আম্মা ও তোমার সঙ্গে জমিতে বসে আমরা দুপুরের খাবার খেতাম। জীবনটা তখন খুব সুখের মনে হতো। অন্ধ্র প্রদেশের আনন্দপুর এলাকায় আমাদের ছোট্ট জমিটাতে অনেক ফসল হতো। কী যে সুন্দর ছিল সে ফসলগুলো। তুমি এখন নেই। আমি তোমাকে এখনো খামারে এসে খুঁজে বেড়াই।
আমি এখন বুঝতে পারি, আমাদের ভরণপোষণ করানোটা তোমার জন্য কতটা কঠিন ছিল। তুমি সাহসী ছিলে। কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছ অনেকবার। পার করে দিয়েছ কষ্টের দিনগুলো। কিন্তু সময়টা খারাপ হচ্ছিল। উপার্জন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল তোমার জন্য।’
লক্ষ্মী লিখেছেন, ‘আব্বা তোমার মনে আছে, নদীর ধারে তুমি আমাদের সঙ্গে সময় কাটাতে। আমি ছোট ছিলাম। তাই তোমরা আমাকে নদীতে নামতে দিতে না। বলতে, আমি বড় হলে নদীতে গোসল করতে পারব। কিন্তু আমি বড় হতে হতে নদীর পানি শুকিয়ে গেল। মনে পড়ে, আমার বয়স যখন ৮ বছর, তখন গ্রামে খরা এল। কী চরম সেই খরা! শুধু নদী না, সব পানিই শুকিয়ে গেল। তুমি কুয়া খুঁড়তে বড় একটা জমি বিক্রি করে দিলে। কিন্তু সেই কুয়ার পানিও শুকিয়ে গেল। এখনো মনে পড়ে তোমার সেই দুঃখী চেহারাটা। মনে পড়ে, তুমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে চেয়ে থাকতে। হয়তো বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে।
আমার বয়স বাড়ছিল। ১২ বছরে এসে আমি সংসারের অভাবটা ভীষণভাবে টের পেলাম। আবারও খরা এল গ্রামে। নদী, কুয়া সব শুকিয়ে গেল। তুমি কিন্তু হাল ছাড়োনি। লোকের কাছে ধার করে হলেও একের পর এক কুয়া খুঁড়তে শুরু করলে। এবারও লাভ হলো না। সব শুকিয়ে গেল।’
লক্ষ্মীর চিঠিতে এরপর আসে ভয়ংকর সেই ২০১৮ সালের ৯ আগস্টের কথা। যেদিন তাঁর বাবা কিছু জিনিস কেনার কথা বলে বাইরে যান। পরের দিন বাবার জমিতেই তাঁর লাশ পাওয়া যায়। লক্ষ্মী বুঝতে পারেন, মালাপ্পা মিথ্যে বলেননি। শেষকৃত্যের জন্য যা যা দরকার, সেসবই কিনতে গিয়েছিলেন। আর সব জিনিস রেখে দিয়েছিলেন তাঁর কবরে। সেগুলো দিয়েই তাঁর শেষকৃত্য হয়।
বাবা চলে গেলেন। তবে খরা গেল না। মালাপ্পা সব দায়িত্ব রেখে গেলেন সন্তানদের ওপর। লক্ষ্মী দেখলেন, বাবার মতোই দুশ্চিন্তা এবার তাঁর ভাইদের মুখে। ভাইয়েরাও কী একইভাবে তাঁদের সন্তানদের ওপর দায়িত্ব দিয়ে আত্মহত্যা করবেন?
লক্ষ্মী তাই প্রশ্ন তুলেছেন। লক্ষ্মীর প্রশ্নগুলো খুব সাদামাটা। সহজ। উত্তরটা কঠিন। লক্ষ্মী জানতে চান, সব কৃষকের পরিণতি কী একই? তাহলে মানুষ কৃষিকাজ করে কেন? কেন সরকার কৃষকদের জন্য কিছু করে না? খরার কারণে হাজার হাজার কৃষক মারা গেছেন। লক্ষ্মীর বাবাও তাঁদের একজন।
লক্ষ্মী তাঁর প্রশ্নের উত্তর পাননি। চিঠির শেষেও তাই কোনো সমাধান নেই। আছে কেবল হারিয়ে যাওয়া বাবার জন্য আদরের মেয়ের অনুভূতি। ‘তোমার কথা খুব মনে পড়ে, আব্বা।’