হঠাৎ লাদাখে মোদি, চীনকে কড়া হুঁশিয়ারি

চীনের সঙ্গে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ লাদাখ সীমান্তে হাজির হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স
চীনের সঙ্গে উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে হঠাৎ লাদাখ সীমান্তে হাজির হন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

কাকপক্ষীকে টের পেতে না দিয়ে সবার অলক্ষ্যে লাদাখে গিয়ে চীনের উদ্দেশে কড়া বার্তা দিয়ে এলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আজ শুক্রবার সকালে লাদাখের রাজধানী লেহতে নেমে কিছু সময়ের মধ্যে ফরওয়ার্ড ঘাঁটি নিমুতে গিয়ে সেনা জওয়ানদের সঙ্গে তিনি কথা বলেন। তারপর সেনানীদের সমাবেশে চীনের নাম না করে তিনি বলেন, ‘সারা বিশ্বে সম্প্রসারণবাদীদের দিন শেষ হয়ে গেছে। শুরু হয়েছে বিকাশবাদের দিন। ইতিহাস সাক্ষী, সম্প্রসারণবাদীরা হয় পরাস্ত হয়েছে, নয় বাধ্য হয়েছে পিছু হটতে।’

লাদাখে যে প্রধানমন্ত্রী যেতে পারেন, তার কোনো ইঙ্গিত বৃহস্পতিবার রাতেও ছিল না। বরং ঠিক ছিল, শুক্রবার লাদাখে যাবেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। বৃহস্পতিবার রাতে সরকারিভাবে রাজনাথের সফর দুদিন পিছিয়ে গেছে জানানো হলেও প্রধানমন্ত্রীর যাওয়ার বিষয়টি গোপন রাখা হয়। সেনাপ্রধান ছাড়াও মোদির সঙ্গে এই সফরে উপস্থিত ছিলেন চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ বিপিন রাওয়াত। লেহতে থাকাকালীন মোদি গলওয়ান সংঘর্ষে আহত চিকিৎসাধীন জওয়ানদের সঙ্গেও দেখা করেন।
সেনানীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ দূরদর্শনে দেখানো হয়। মোদি বলেন, ‘বিশ্বের কোনো দেশের কাছেই ভারত মাথা নোয়ায়নি, নোয়াবেও না। আপনাদের সাহস ও আত্মোৎসর্গ তুলনাহীন। যে অবস্থানে আপনারা রয়েছেন, আপনাদের মনোবল ও দৃঢ়তা তার চেয়েও অনেক উঁচুতে। আপনাদের চোখে ভারতমাতার শত্রুরা সেই আগুন ও ক্ষিপ্রতা দেখেছে। আপনারা পাহাড়ের মতো কঠিন ও শক্তিশালী, আপনাদের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস হিমালয়ের মতো অটল।’
মোদি বলেন, ‘গলওয়ানে যে পরিস্থিতিতে আপনারা দেশরক্ষায় ব্রতী, তা বিশ্বের কঠিনতম এলাকা। ভারতের সেনাবাহিনী যে বিশ্বের সেরা, বারবার সে প্রমাণ আপনারা রেখেছেন। এখানে যে দৃঢ় বার্তা আপনারা দিয়েছেন, তা বিশ্বের কোণে কোণে পৌঁছে গেছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মাতৃভূমির জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের এবং আপনাদের আমি সেলাম জানাই। লাদাখের প্রতিটি নদী, নুড়িপাথর, প্রতিটি কোনা জানে এটা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।’
সন্দেহ নেই, চীনের নামোচ্চারণ না করলেও প্রধানমন্ত্রীর এই বার্তা পুরোপুরি উত্তরের প্রতিবেশীর প্রতি। লাদাখে চীন নতুন করে ভারতীয় জমি কবজা করেছে, সে কথা মোদি ও ভারত সরকার এখনো স্বীকার করেনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে ‘সম্প্রসারণবাদের’ উল্লেখ সেই সত্যই প্রমাণ করে। এই সফরের আগে শুক্রবার চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ ও সেনাপ্রধানের সঙ্গে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছিল। একই দিনে জানানো হয়েছিল, রাশিয়া থেকে ৩৩টি নতুন যুদ্ধবিমান কেনার সিদ্ধান্তের কথা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান শুক্রবার বলেছিলেন, দুই দেশের আলোচনা অব্যাহত। এই অবস্থায় দুই দেশেরই এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। এখন দেখার, সপার্ষদ মোদির লাদাখ সফর ও সম্প্রসারণবাদ প্রসঙ্গে চীন কী প্রতিক্রিয়া দেয়।
গলওয়ান-উত্তর পরিস্থিতিতে লাদাখে গিয়ে মোদি কোন বার্তা দিতে চাইলেন চীনকে? কূটনৈতিক মহলের ধারণা, সামরিক স্তরে উচ্চপর্যায়ের তিন তিন দফা আলোচনা সত্ত্বেও চীন গলওয়ান উপত্যকায় মে মাসের পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যায়নি। জুন মাসে তিন-তিনবার আলোচনা সত্ত্বেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার স্থিতাবস্থা রক্ষায় সম্মত হয়নি। বরং তাদের অবস্থান পোক্ত করতে চাইছে। এটা ভারত যে বেশি দিন বরদাশত করবে না, সফরের মধ্য দিয়ে মোদি সেটাই বোঝাতে চেয়েছেন। ভারত যে শান্তি চায়, তা বোঝাতে মোদি তাঁর ভাষণে বলেন, ‘দুর্বলতা শান্তি আনতে পারে না। সাহসীরাই পারে। আমরা বংশীধারী শ্রীকৃষ্ণকে যেমন মান্য করি, তেমনই সুদর্শন চক্রধারী কৃষ্ণও আমাদের আরাধ্য। বিশ্বে শান্তি স্থাপন ও মানবতার প্রসারে ভারত সব সময় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।’

লাদাখে দেওয়া বক্তব্যে চীনের প্রতি কড়া বার্তা দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি । ছবি: এএফপি

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ সৌমিত্র রায়ের মতে, প্রধানমন্ত্রী এই সফরের মধ্য দিয়ে অনেককে অনেক বার্তা দিয়েছেন। শুক্রবার কলকাতা থেকে ফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এই সফরে চীনকে বোঝালেন, ভারত কিন্তু ১৯৬২তে থমকে নেই। শান্তিকামী, কিন্তু দেশরক্ষায় একাগ্র। আবার চীনের নাম না করে গলওয়ান থেকে তাদের পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগও তিনি দিয়ে রাখলেন। ফরওয়ার্ড ঘাঁটিতে গিয়ে বাহিনীর মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছেন প্রবলভাবে। আর গোটা বিশ্বকে বোঝালেন, চীন আগ্রাসী। গলওয়ানে তাদের আগ্রাসন ভারত মেনে নিচ্ছে না। এর সমাধান হওয়া জরুরি। এই সফরের মধ্য দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনেও তিনি সক্রিয় হলেন।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বয়কট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নানাবিধ অর্থনৈতিক চাপ ও সামরিক প্রস্তুতির মুখে চীন সমঝোতা মেনে পূর্ববর্তী অবস্থানে ফিরে যায় কি না, সেটাই দেখার।
রাশিয়া থেকে আরও যুদ্ধবিমান কিনছে ভারত
সামরিক প্রস্তুতিতে ভারত অবশ্য কোনো খামতি রাখছে না। আজ ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় রাশিয়া থেকে প্রায় আড়াই বিলিয়ন ডলারের অতিরিক্ত সামরিক সম্ভার কেনার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। কেনা হবে ২১টি মিগ-২৯ ও ১২টি সুখোই-৩০ এমকেআই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া ৫৯টি মিগ-২৯ বিমান উন্নত করা হবে। দুই বছর আগে ২০১৮ সালে প্রায় সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে রাশিয়া থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার বিষয়ে ভারত চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল।