ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যাসিড টেস্ট’, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের অবস্থা এখন ঠিক সে রকম। ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের শীর্ষ পদে বসার পর এই প্রথম তাঁর দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ। আগ্রহ যেমন শাসক দলের, তেমনই গোটা বিরোধীকুলেরও। এমনকি শাসক-বিরোধী কোনো দিকে না—ঝোঁকা সাধারণ শান্তিপ্রিয় অথচ সজাগ মানুষের নজরেও আটকা পড়েছেন এই বিচারপতি। শুক্রবার সকালে তাঁর সিদ্ধান্তের ওপরে অনেকটাই নির্ভর করবে ভারতের রাজনীতির পরবর্তী বাঁক এবং সেই সঙ্গে নির্ধারিত হবে দেশের সবচেয়ে দক্ষ, সেরা ও ক্ষমতাবান গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের ভাগ্য। যার ১ ও ২ নম্বর কর্তাকে মঙ্গলবারের গভীর রাতে ছেঁটে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
১ নম্বর মানে, সিবিআইয়ের ডিরেক্টর অলোক ভার্মা, পরের দিন সকালেই ন্যায়বিচারের আশায় দ্বারস্থ হন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের এজলাসে। সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে তাঁর অভিযোগ, সংস্থার স্বাধীন ও স্বশাসিত চরিত্রকে সরকার খর্ব করেছে। তা করা হয়েছে এই আশঙ্কায় যে কিছু অতীব স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের তদন্ত সরকারের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারে ভেবে। ২ নম্বরের বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি সংস্থার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের বদল করে দেওয়ার অভিযোগও এনেছেন অলোক ভার্মা। কাল শুক্রবার সকালে এই আবেদনের মীমাংসা প্রধান বিচারপতি কীভাবে করেন, আগ্রহ জমাট বেঁধেছে তা ঘিরেই। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত অতঃপর কোন দিকে এগোবে তা নির্ভর করছে এই রায়ের ওপর।
সবচেয়ে বড় আগ্রহটা যাকে ঘিরে, ইদানীং ভারতের রাজনীতিতে সেটাই টগবগ করে ফুটছে। রাফাল কেনাবেচা। ফ্রান্সের এ যুদ্ধবিমান কেনাবেচার বিষয়টি এই ভোটের মৌসুমে শাসক দলকে তিষ্ঠোতে দিচ্ছে না। দুর্নীতির অভিযোগে কংগ্রেস সরাসরি কাঠগড়ায় তুলে দিয়েছে খোদ প্রধানমন্ত্রীকে। বলতে দ্বিধা নেই, রাফাল হয়ে দাঁড়িয়েছে বিজেপির গলার কাঁটা ও ঘাড়ের ব্যথা। একসময়ের দলীয় সদস্য ও মন্ত্রী অরুণ শৌরি এবং যশবন্ত সিনহা আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণকে সঙ্গে নিয়ে অলোক ভার্মার কাছে রাফাল কেনাবেচার দুর্নীতির তদন্ত করার আরজি জানিয়ে এসেছেন কিছুদিন আগে। জমা দিয়েছেন ১৩২ পৃষ্ঠার নথি। তদন্তের দাবি কংগ্রেসেরও। অলোক ভার্মা অপসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাফাল নিয়ে ওই ত্রিমূর্তি রঞ্জন গগৈয়ের কাছে গিয়ে নতুন করে আরজি জানিয়ে এসেছেন। কংগ্রেস সভাপতি রাখঢাক না রেখেই বলেছেন, রাফালের তদন্তের দিকে এগোচ্ছিলেন বলেই অলোক ভার্মাকে মোদি সরকার সরিয়ে দিয়েছে। সরে যাওয়ার আগে যে অভিযোগগুলো অলোক ভার্মা বিবেচনা করছিলেন, সেই তালিকায় রাফাল সবার ওপরে।
মেডিকেল কাউন্সিল ঘুষকাণ্ড মামলা সেই তালিকায় দ্বিতীয়। হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ইসরাত মাসরুর কুদ্দুসিকে চার্জশিট দিতে সিবিআই প্রস্তুত। অপেক্ষা শুধু অলোক ভার্মার অনুমতির। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি এস এন শুক্লর বিরুদ্ধেও রয়েছে টাকা নিয়ে ডাক্তারিতে ভর্তি করানোর অভিযোগ। অভিযোগ ওঠার পরেই তাঁকে ছুটিতে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্তে সিবিআই রাজি। প্রয়োজন শুধু ডিরেক্টরের সম্মতি। কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় অর্থ ও রাজস্ব সচিব হাসমুখ আধিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এনেছেন বিজেপির নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী। তদন্তের জন্য সিবিআইকে আরজিও জানিয়েছেন। সেই বিষয়েও সিদ্ধান্ত ঝুলে রয়েছে। ঝুলে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের এক আমলার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগও।
অনিশ্চিত হয়ে গেছে, সিবিআইয়ের ২ নম্বর রাকেশ আস্তানার বিরুদ্ধে আনা অলোক ভার্মার অভিযোগগুলোর ভাগ্যও। আস্তানার বিরুদ্ধে যাঁরা তদন্ত করছিলেন, তাঁদের সবাইকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। অলোক ভার্মার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার রায় দিলে, ছুটিতে যাওয়ার সরকারি নির্দেশ খারিজ করে দিলে, সিবিআইয়ের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও আমূল বদলে যাবে। ক্ষমতাসীন হয়ে ভার্মা নতুন উদ্যমে তদন্তের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবেন। অনিশ্চিত হয়ে যাবে রাকেশ আস্তানার ভাগ্য। কিন্তু তা না ঘটলে প্রধানমন্ত্রীর ‘ব্লু আইড বয়’ রাকেশ আস্তানার বিরুদ্ধে যাবতীয় অভিযোগের তদন্ত ধামা চাপা পড়বে। তাঁর কর্মজীবন সাময়িকভাবে হয়তো অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, কিন্তু ওই পর্যন্ত। দুর্নীতির গুরুতর অভিযোগের হাত থেকে নিজেকে তিনি মুক্ত করে ফেলবেন।
তবে সিবিআইয়ের গায়ে যে কালো দাগ লেগে গেল, যেভাবে এই সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে তার মেরামত হবে সেই ধারণা আপাতত কারও নেই। এই মুহূর্তে দেশের দৃষ্টি সুপ্রিম কোর্টের ওপর।
আরও পড়ুন:
সিবিআই এখন বিবিআই: মমতা
‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ সফল হবেন মোদি?
ভারতে সিবিআইয়ের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে ছুটি
সিবিআইয়ে ক্ষমতার লড়াই