মোদির হার-জিতে কী হবে?

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজের ব্যক্তি ক্যারিশমার ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে ভোটের মঞ্চের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেসকে স্রেফ দর্শক বানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ছবি: রয়টার্স
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজের ব্যক্তি ক্যারিশমার ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে ভোটের মঞ্চের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেসকে স্রেফ দর্শক বানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ছবি: রয়টার্স

ভারতে লোকসভা নির্বাচনের সর্বশেষ ধাপের ভোটগ্রহণ চলছে। এর পরেই শুরু অপেক্ষার পালা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফের দিল্লিতে রাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন কিনা—তা নিয়ে বাহাস তুঙ্গে। কিন্তু মোদির হার-জিতে আসলে কী হবে?

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজের ব্যক্তি ক্যারিশমার ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে ভোটের মঞ্চের সব আলো কেড়ে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কংগ্রেসকে স্রেফ দর্শক বানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে ২৮২টি আসনে জিতে গিয়েছিল বিজেপি। ১৯৮৪ সালের পর ওই প্রথম এত বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল। ১৯৮৪ সালের প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে, বিজেপির ওই অবিস্মরণীয় উত্থানের মহিমা আরও বেড়ে যায়। কারণ ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার কিছুদিন পর লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাতে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি মানুষের সহানুভূতি ব্যালট হয়ে রাজীব গান্ধীর পকেটে ঢুকেছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে তেমন কোনো ঘটনা ছিল না। শুধু ছিল কংগ্রেস শাসনের প্রতি ভারতীয় জনগণের বিতৃষ্ণা এবং প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী মোদির সমৃদ্ধিশালী ভারত গড়ার প্রতিশ্রুতি।

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স

সেই প্রতিশ্রুতিতে ভালোই ভুলেছিল ভোটারদের মন। ফলে জোট থাকলেও সরকার গঠনের জন্য জোটসঙ্গীদের দরকার পড়েনি বিজেপির। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। আগেরবারের শক্ত ভিত্তি এবার বেশ নড়বড়ে। বিভিন্ন শ্রেণির ভোটাররা এবার অসন্তুষ্ট চিত্তে ভোট দিতে যাচ্ছেন। কারণ ২০১৪ সালে দেওয়া মোদির প্রতিশ্রুতির ফোয়ারা যে কেবল গাল ভরা বুলিই থেকে গেছে, তা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। ঠিক এই বিষয়টিকে অস্ত্র বানিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে কংগ্রেসসহ তাবৎ বিরোধীরা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষফোড়া। এবারের নির্বাচনে এতটা প্রতিরোধ আসলে আশা করেনি মোদির গেরুয়া বাহিনী। আকস্মিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েই নড়বড়ে হয়ে পড়েছে বিজেপির আত্মবিশ্বাসের স্তম্ভ।

সরকার: নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যদি চলতি লোকসভা নির্বাচনে ২০০-এর কাছাকাছি আসনও পায়, সে ক্ষেত্রেও মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা নিশ্চিত। কিন্তু বিজেপির আসনসংখ্যা যদি ১৭৫ বা তার নিচে নেমে যায়, তবে ভালো ঝামেলায় পড়বে বিজেপি। কারণ তখন জোটসঙ্গীদের মুখাপেক্ষী হতে হবে মোদিকে। সরকার গঠন করতে হলে প্রয়োজন লোকসভার ২৭২টি আসন। অর্থাৎ তখন এক শর মতো আসন জোগাড় করতে হবে বিজেপিকে। অন্যদিকে কংগ্রেস যদি ১৩০টির বেশি আসনে জিতে যায়, তখন বিজেপির সরকার গঠন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। কারণ জোটসঙ্গীদের সঙ্গে কংগ্রেসের সমীকরণ তুলনামূলক সহজ।

নরেন্দ্র মোদির বিজেপি যদি চলতি লোকসভা নির্বাচনে ২০০-এর কাছাকাছি আসনও পায়, সে ক্ষেত্রেও মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা নিশ্চিত। কিন্তু বিজেপির আসনসংখ্যা যদি ১৭৫ বা তার নিচে নেমে যায়, তবে ভালো ঝামেলায় পড়বে বিজেপি। ছবি: রয়টার্স

মোদি হেরে গেলে তাই স্বাভাবিকভাবেই একটি নড়বড়ে কেন্দ্রীয় সরকার গঠন হবে দিল্লিতে। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতিতে জোটসঙ্গীদের সরকার গঠনে এগিয়ে দিয়ে সেই সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন দিতে পারে কংগ্রেস। দলটির সভাপতি রাহুল গান্ধী বারবারই জোর দিচ্ছেন, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শক্তির ক্ষমতায় আসার ওপরে। কেন্দ্রীয় সরকার নড়বড়ে থাকলে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়ে। আর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে মধ্যবর্তী নির্বাচনের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবে কংগ্রেসই। অন্তত ভারতের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস তারই পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।

মোদি ফের প্রধানমন্ত্রী হলেও কেন্দ্রীয় সরকার অস্থিতিশীলই থাকবে। কারণ এবার অবধারিতভাবেই জোটসঙ্গীদের ওপর নির্ভরতা বাড়বে বিজেপির। ফলে যেভাবে এত দিন অঘোষিত জরুরি অবস্থা জারি করে একক সিদ্ধান্তে সব দপ্তর চালাতেন মোদি, সেটি হোঁচট খাবে। চাইলেও আর সব কৃতিত্ব নিজের ঝুলিতে ভরতে পারবেন না নরেন্দ্র মোদি। কারণ পরের ধনে পোদ্দারি করা গেলেও, দিন শেষে অনেক জবাবদিহি করতে হয়।

অর্থনীতি: সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছে ভারতের অর্থনীতি। এবারের লোকসভায় যে পক্ষই সরকার গঠন করুক না কেন, সেই সরকারকেই অর্থনীতি চাঙা করার গুরুদায়িত্ব কাঁধে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতের অর্থনীতির চাকা বেজায় ধীর গতিতে চলছে। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, যা গত ছয় প্রান্তিকের মধ্যে সর্বনিম্ন। কমে গেছে গাড়িসহ অন্যান্য বিলাসদ্রব্যের বিক্রি। ৩৩৪টি কোম্পানির লাভের পরিমাণ আগের চেয়ে গড়ে ১৮ শতাংশ কমেছে। ভারতের উড়োজাহাজের বাজারে ভাটা পড়েছে, এর বিস্তৃতির গতি গত ছয় বছরের মধ্য সর্বনিম্নে পৌঁছেছে।

ঋণ মকুব ও ফসলের ন্যায্য দামের দাবিতে গত নভেম্বরে দিল্লিতে সমাবেশ করেছিলেন কয়েক হাজার কৃষক। এই কৃষকেরা সংসদ অভিযানেও শামিল হন। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও করনেল ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক কৌশিক বসু বলছেন, ভারতের অর্থনীতির চাকা ধীর হয়ে পড়ার বিষয়টি বেশ আশঙ্কাজনক। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইকোনমিক অ্যাডভাইজরি কাউন্সিলের সদস্য রথীন রায় বলছেন, এভাবে চলতে থাকে ভারত ‘মধ্য আয়ের ফাঁদে’ আটকে পড়বে। আর একবার এই ফাঁদে আটকে গেলে, তা থেকে বের হওয়া বেশ কঠিন।

মোদি হারলে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলো নতুন উদ্যমে অর্থনীতির হাল ধরার সুযোগ পাবে। যদিও কাজটি বেশ কঠিন, কিন্তু অন্তত একটি বদলের সম্ভাবনা থাকে। আর মোদি যদি জেতেন, তখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হবে—আদৌ কি অর্থনীতির উন্নয়ন করতে পারবেন মোদি? কারণ অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এলেও কিছুই করেননি নরেন্দ্র মোদি। বেকারত্বের হার হয়েছে আকাশচুম্বী। এসব থেকে উত্তরণের জন্য কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনাও ঘোষণা করেননি মোদি। উল্টো নোট বাতিল, জিএসটি আরোপের মতো বিতর্কিত পদক্ষেপে হয়রান করেছেন সাধারণ মানুষকে। পাঁচ বছরে যে কাজ শুরুই করেননি মোদি, তা আগামী পাঁচ বছরে আর কতটুকু এগোবে? এই প্রশ্ন কিন্তু এড়াতে পারবেন না নরেন্দ্র মোদি।

কৃষি, কৃষক ও দারিদ্র্য: এই জায়গায় মোদির ‘ত্রাহি মধুসূদন’ অবস্থা। গত বছর ভারতজুড়ে বিশাল বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কৃষকেরা। কারণ কৃষিপণ্যের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষকেরা। আছে কৃষিঋণের ভার। ২০১৬ সালের নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। এই আর্থিক ক্ষতি সামাল দিতে গিয়ে তারা আবার ঋণ নিয়েছেন। সেই ঋণের সামগ্রিক চাপ পড়েছে ভারতের অর্থনীতিতে। বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা, এই ক্ষুব্ধ কৃষকদের কারণেই গত ডিসেম্বরে ছত্তিশগড়, রাজস্থান ও মধ্য প্রদেশে স্থানীয় নির্বাচনে হারতে হয়েছে বিজেপিকে। একই কারণে বিপদ হতে পারে এই লোকসভা নির্বাচনেও।

ভোটের আগ দিয়ে কৃষকদের ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাঠিয়ে কিছুটা বাগে আনার চেষ্টা করেছেন মোদি। কিন্তু তিনি জিতলে এ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক কোনো পদক্ষেপ নেবেন—এমন বিশ্বাস খুব কম মানুষেরই আছে। কারণ এত দিন ধরে শুধু ধনী কৃষক ও জোতদারদের পক্ষেই ছিলেন তিনি। অবশ্য এবারও ব্যাপক গ্রামীণ উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। নির্বাচিত হলে গ্রামীণ উন্নতিতে ২৫ ট্রিলিয়ন রুপি বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে হয়তো ফের নিজের ক্যারিশমা দিয়ে সবকিছু মোকাবিলার চেষ্টা করবেন, সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ যন্ত্রে ভোটারদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেই অস্ত্রের ধার এখন কমতে শুরু করেছে। ছবি: রয়টার্স

অন্যদিকে ‘গরিবের বন্ধু’ হিসেবে কংগ্রেসের সুনাম আছে। সেদিক থেকে কংগ্রেসের দেওয়া প্রতিশ্রুতির ‘কিঞ্চিৎ’ পরিমাণ বাস্তবায়নেরও আশা থাকে। নিজেদের ভোটব্যাংক রক্ষার জন্যই এই কাজ করতে বাধ্য থাকে কংগ্রেস। এবারের নির্বাচনে ৫ কোটি দরিদ্র পরিবারকে মাসে ছয় হাজার রুপি করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কংগ্রেস, দিয়েছে কৃষকদের সহায়তার প্রতিশ্রুতিও। এর বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সামাজিক পরিস্থিতি: নিন্দুকেরা বলেন, নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ভারতের বহুত্ববাদী সমাজের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটি করেছেন। বিজেপি ভারতের সমাজে বিভক্তির রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যকার এই বিভেদ সহজে মিটবে না। মোদি হারলেও ভারতীয় সমাজে চোরাস্রোতের মতো বইবে বিভেদের সুর। হয়তো এর তীব্রতা কিছুটা কমবে, কিন্তু একদম মুছে যাবে না। আর যদি মোদি নির্বাচনে জেতেন, তবে তো কথাই নেই! রাজ্যে রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতার সুর চড়বে, আর সংখ্যালঘুরা থাকবেন নিরাপত্তাহীনতায়। যত যাই হোক, ব্র্যান্ড মোদি কখনোই নিজের গা থেকে সাম্প্রদায়িক গেরুয়া রং মুছতে পারবেন না।

অর্থাৎ, নরেন্দ্র মোদি থাকুন আর নাই থাকুন—ভারতের আগামী সরকারকে কিছু অবশ্যম্ভাবী সমস্যায় পড়তে হবেই। মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে হয়তো ফের নিজের ক্যারিশমা দিয়ে সবকিছু মোকাবিলার চেষ্টা করবেন, সাম্প্রদায়িকতার বিভেদ যন্ত্রে ভোটারদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেই অস্ত্রের ধার এখন কমতে শুরু করেছে। এখন মানুষ ফল চাচ্ছে, বুলি নয়। ২৩ মে স্পষ্ট হবে, কোন পথে যেতে চায় ভারত!

তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য উইক, ব্লুমবার্গ, স্ক্রল ডট ইন, এনডিটিভি, ফিন্যান্সিয়াল টাইমস ও ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস