ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রথম পর্বের ভোটের প্রচার শেষ হতে বাকি মাত্র দুই সপ্তাহ। এই শেষবেলার চমক হিসেবে অবশিষ্ট যা কিছু, তা প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। দুই দিন ধরে তিনি নিজেই নিজেকে ঘিরে তৈরি করেছেন এক অদ্ভুত হেঁয়ালি, প্রহেলিকা।
হেঁয়ালির শুরু শুক্রবার। কংগ্রেসের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশের পর সংবাদ সম্মেলনে প্রিয়াঙ্কাকে সরাসরি প্রশ্ন করা হয়েছিল, দল উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় এলে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হবেন কি না। উত্তরে হাসিমুখে ওই নারী সাংবাদিককে তিনি পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আর কোনো মুখ কি দেখতে পাচ্ছেন? সব জায়গায় তো আমারই মুখ দেখছেন?’
ওই উত্তর থেকেই ঝড়ের বেগে ছড়িয়ে পড়ে যে জল্পনা, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রিয়াঙ্কা নিজেই এক সাক্ষাৎকারে তার নিরসন ঘটান। এনডিটিভিকে দেওয়া সেই সাক্ষাৎকারে কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও উত্তর প্রদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রিয়াঙ্কা বলেন, যেখানেই যান, এই প্রশ্ন তাঁকে শুনতে হয়। সেই কারণে একটু ঠাট্টাচ্ছলে লঘুভাবে ওই উত্তর দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আপনি ধরে নিতে পারেন না যে আমি মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী। আমি দলের সাধারণ সম্পাদক। উত্তর প্রদেশের দায়িত্ব আমার। আমি সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছি। আনুষ্ঠানিকভাবে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে কাউকে চিহ্নিত করে দল সম্ভবত নির্বাচনে যাচ্ছে না।’
এ কথা বলার পর প্রিয়াঙ্কা আরও এক জল্পনার জন্ম দেন। কেন ভোটে দাঁড়াচ্ছেন না জানতে চাওয়া হলে তিনি জবাব দেন, ‘দাঁড়াচ্ছি না কী করে ধরে নিলেন? দাঁড়াতেও তো পারি?’ পরক্ষণেই এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘ভোটে লড়ব কি না, সেই সিদ্ধান্ত পরে নেব। নিলে অবশ্যই জানিয়ে দেব।’ ভোটে দাঁড়ালে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে লড়বেন কি না, কারণ সে ক্ষেত্রে একটা স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যাবে, এ কথা জানতে চাওয়া হলে প্রিয়াঙ্কা বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তিনি বলেন, ‘বার্তা নানাভাবে দেওয়া যায়। দুই–আড়াই বছর ধরে নানাভাবে সেই বার্তা আমি দিয়ে আসছি।’
প্রিয়াঙ্কা উত্তর প্রদেশ থেকে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে অবশ্যই তা হবে নবতম চমক। এবারের ভোট নিয়ে টান টান উত্তেজনায় নিঃসন্দেহে তা যোগ করবে এক অন্য মাত্রা। কারণ, সে ক্ষেত্রে সেটাই হবে তাঁর প্রথম নির্বাচনী অভিযান। শুধু তিনিই নন, মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ এবং এবার তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জার সমাজবাদী পার্টির নেতা অখিলেশ যাদবও এই প্রথমবার বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হতে চলেছেন।
পাঁচ বছর ধরে মুখ্যমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করে এলেও যোগী আদিত্যনাথ কখনো রাজ্য বিধানসভায় প্রার্থী হননি। ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি নির্বাচিত হয়ে আসছেন লোকসভায়। ২০১৭ সালে সাংসদ হিসেবে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি মনোনীত হন বিধান পরিষদে। এবার প্রথম বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করেছে বিধানসভায়। দল অযোধ্যায় তাঁকে প্রার্থী করতে চাইলেও তিনি নিজের চেনা গোরক্ষপুরের বাইরে যেতে রাজি হননি। গোরক্ষপুর শহর কেন্দ্র থেকে এবার তিনি প্রার্থী হয়েছেন।
তাঁরই মতো প্রথমবার বিধানসভায় দাঁড়ালেন অখিলেশ যাদবও। ২০০০ সালে কনৌজ লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জিতে সাংসদ হয়েছিলেন অখিলেশ। তারপর ২০০৪ ও ২০০৯ সালেও লোকসভায় জিতে সাংসদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০১২ সালে ৩৮ বছর বয়সে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে লোকসভার সদস্যপদ ছেড়ে বিধান পরিষদের সদস্য হন। গতকাল শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হলো, দলের খাসতালুক বলে বিবেচিত মৈনপুরি জেলার কারহাল বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তিনি প্রার্থী হচ্ছেন।
কংগ্রেসের ক্ষমতা হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর প্রদেশের ভোট হয়ে উঠেছিল চতুর্মুখী। বিজেপি, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও কংগ্রেসের মধ্যে রাজ্যের আসন ভাগ–বাঁটোয়ারা হয়ে এসেছে। ২০১৪ থেকে বিজেপি এই রাজ্যে বাকি কাউকে দাঁত ফোটাতে দেয়নি। এই প্রথম আপাতদৃষ্টিতে লড়াই আবার জমজমাট এবং দ্বিমুখীও। এবারের লড়াই মুখ্যত বিজেপির সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির। সেখানে প্রিয়াঙ্কার প্রার্থী হওয়া না হওয়া এখনো বিশেষ অর্থবহ হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তবু কংগ্রেসের একটা বড় অংশ চায়, ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রিয়াঙ্কার উচিত রাজ্যে প্রার্থী হওয়া।
সেই ভবিষ্যতের স্বার্থেই এই প্রথম কংগ্রেস আর্যাবর্তের জাতপাতের লড়াইয়ে না গিয়ে ‘জেন্ডার ইস্যু’ বা লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতিকে হাতিয়ার করেছে। নারীদের মঙ্গলের জন্য গ্রহণ করেছে বহুবিধ কর্মসূচি। নারীর ক্ষমতায়নকে করেছে পাখির চোখ। সেই সঙ্গে জোর দিয়েছে যুব সম্প্রদায়ের ওপর। এত দিন ধরে যাবতীয় প্রচার ও দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারের অভিমুখও সেই দিকে। পূর্বঘোষণা মতো প্রিয়াঙ্কা কংগ্রেসের প্রার্থী তালিকায় ৪০ শতাংশ নারীকে জায়গা দিয়েছেন। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে যুব সম্প্রদায়ের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে কর্মসংস্থানের ওপর। বলেছেন, নতুন রাজনৈতিক আবহ তৈরি করতে চান, যা হবে ইতিবাচক। জানিয়েছেন, নেতিবাচক রাজনীতি করা দলের লক্ষ্য নয়। স্পষ্টতই, প্রিয়াঙ্কা চাইছেন আগামী দিনের জন্য রাজ্যে কংগ্রেসের একটা জায়গা তৈরি করতে, যাতে ২০২৭ সালে রাজ্য রাজনীতিতে সমীহ আদায় করা যায়।
কিন্তু সে জন্য এবারের ভোটে প্রার্থী হওয়া জরুরি। জরুরি ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার স্বার্থেই। জল্পনা উসকে দিলেও সেই সাহস প্রিয়াঙ্কা কি দেখাতে পারবেন?