কু-কথার এমন ভরা বর্ষণ ভারতে আর কোনো নির্বাচনে আগে কোনো দিন হয়নি। এত কটাক্ষ, পরস্পরকে তাচ্ছিল্যের এমন বন্যাও দেখা যায়নি। বিষয়কে বাদ দিয়ে এমন ব্যক্তিগত আক্রমণের নিরিখে সেই দিক থেকে এবারের ভোট–প্রচার অভূতপূর্ব এবং অবশ্যই অশ্রুতপূর্ব।
এই অভিনবত্বের সর্বশেষ সংস্করণ মণিশঙ্কর আয়ার, কু-কথার দায়ে যিনি কংগ্রেস থেকে আগেই ছয় বছরের জন্য বরখাস্ত হয়েছেন।
মণিশঙ্কর আয়ারকে ইন্ধন জোগানকারীর নাম অবশ্য নরেন্দ্র মোদি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এমন দুটি মন্তব্য করেছেন, যার উল্লেখ করে মণিশঙ্কর নিজেকে যথার্থ প্রতিপন্ন করে বলেছেন, দুই বছর আগে মোদিকে উদ্দেশ করে বলা তাঁর ‘নীচ’ মন্তব্যটি ঠিকই ছিল।
দুই বছর আগে, ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর মোদিকে উদ্দেশ করে মণিশঙ্কর নীচ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সেই শব্দটি হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছিল বিজেপির। মোদি থেকে শুরু করে সব নেতাই নীচ শব্দটির ব্যাখ্যা ‘নীচু জাত’ বলে মনে করেছিলেন। যদিও মণিশঙ্করের দাবি ছিল, জাত নয়, তিনি নীচু মনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু মণিশঙ্করকে তিরস্কৃত হতে হয়েছিল দলের কাছে। দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ছয় বছরের জন্য।
সেই বহিষ্কৃত মণিশঙ্কর এবার এক নিবন্ধে তাঁর সেই আগের মন্তব্যের ‘যথার্থতার’ প্রমাণ হিসেবে লিখেছেন, ‘আজ এটা স্পষ্ট, ভাষার প্রয়োগের দিক থেকে সবচেয়ে মুখ খারাপ করা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদায় এই ২৩ মে হয়ে যাবে। আজ কি মনে হচ্ছে না আমি কতটা ঠিক কথা বলেছিলাম?’
মণিশঙ্করকে এই নিবন্ধ লেখার উৎসাহদাতা মোদিই। নির্বাচনী প্রচারে সম্প্রতি তিনি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে ‘এক নম্বরের ভ্রষ্টাচারী’ আখ্যা দিয়েছেন। বোফর্স–সংক্রান্ত অভিযোগের উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন, ‘চাটুকাররা যাঁকে মিস্টার ক্লিন হিসেবে তুলে ধরেছিল, তিনিই হয়ে উঠেছিলেন এক নম্বরের ভ্রষ্টাচারী।’ সেটা ছিল কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগানের জবাব। ওই মন্তব্যের পর গত দুই দিনে মোদি এমন দুটি মন্তব্য করেছেন, যা গোটা দেশে শুধু হাসির খোরাকই হয়ে ওঠেনি, বিরোধীরা যাকে হাতিয়ার করে প্রধানমন্ত্রীর ‘অজ্ঞতা ও মিথ্যাচারের’ নমুনা বলে জাহির করছে। সেই দুই মন্তব্যের একটা হলো, বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলা প্রসঙ্গ। মোদি বলেছেন, বালাকোট সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে বিমানবাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের সময় মেঘ ও বৃষ্টি সমস্যার সৃষ্টি করলে বিমানবাহিনী আক্রমণের দিন পাল্টানোর পরামর্শ দিয়েছিল। সেই আপত্তি অগ্রাহ্য করে মোদি নির্দেশ দেন, মেঘ–বৃষ্টিতে পাকিস্তানি রাডারের চোখ এড়ানো সম্ভব হবে। বিনা বাধায় ভারতীয় বিমানবাহিনী বোমা ফেলে আসতে পারবে।
>লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
এবারের ভোট–প্রচার অভূতপূর্ব এবং অবশ্যই অশ্রুতপূর্ব
এই মন্তব্য শুধু হাসির খোরাকই হয়ে ওঠেনি, দেশের নিরাপত্তাকেও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। মেঘের আস্তরণ রাডারকে ফাঁকি দিতে পারে, এই অভিনব জ্ঞানের জন্য মোদিও হয়ে উঠেছেন হাসির খোরাক।
দ্বিতীয় মন্তব্যও মোদিরই করা। এক টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর দাবি, ১৯৮৭–৮৮ সালে তিনি ‘ডিজিটাল ক্যামেরা’ ব্যবহার করেছিলেন। ভারতে একমাত্র তাঁর কাছেই ওই ক্যামেরা ছিল। সেই ক্যামেরায় গুজরাটে লালকৃষ্ণ আদভানির জনসভার এক ছবি তুলে তিনি ছাপানোর জন্য দিল্লিতে খবরের কাগজের অফিসে ই–মেইল করে দিয়েছিলেন। পরদিন সেই রঙিন ছবি ছাপা হলে বিস্মিত আদভানি জানতে চেয়েছিলেন কী করে তা সম্ভব হলো।
সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর দাবি ও সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। জাপানি কোম্পানি ফুজি প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা বাজারে ছাড়ে ১৯৮৯ সালে। ’৯৪ সালে তা জনপ্রিয় হয় অ্যাপল কোম্পানির সৌজন্যে। প্রশ্ন, কী করে তা হলে দুই বছর আগেই মোদি ডিজিটাল ক্যামেরা পেতে পারেন? ভারতে ই–মেইল প্রথম চালু হয় ১৯৯৫ সালে। প্রশ্ন, মোদি তাহলে ৮৭–৮৮ সালে কী করে ই–মেইল করলেন?
জম্মু–কাশ্মীর থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক রাইজিং কাশ্মীর–এ এসব প্রসঙ্গ তুলে ধরে মণিশঙ্কর লিখেছেন, ‘এখন কি মনে হচ্ছে না ২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর আমার মন্তব্য কতখানি সত্যি ছিল?’