দুই ঘণ্টা বিতর্কের পর বিরোধীদের প্রবল চাপের মুখে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে যুগ্ম সংসদীয় কমিটির (জেপিসি) বৈঠক আরও এক সপ্তাহ পিছিয়ে গেল। খসড়া বিলের ওপর সংশোধনী দেওয়ার প্রস্তাবের সময়ও বাড়ানো হলো দুই দিন। ২২ নভেম্বরের মধ্যে এখন সংশোধনী জমা দিতে সদস্যদের বলা হয়েছে। জেপিসির পরবর্তী বৈঠক ২৭ নভেম্বর।
বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সংখ্যালঘু অর্থাৎ, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, পার্সি, জৈন, শিখ সম্প্রদায়ের ‘অত্যাচারিত মানুষ’ ভারতে চলে এলে তাঁদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ হিসেবে চিহ্নিত না করে নাগরিকত্ব দেওয়ার উদ্দেশ্যে শাসক বিজেপি এই বিলটি প্রস্তুত করেছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, এই তিন দেশের মুসলমানদের চিহ্নিত করা হবে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে এবং তাঁদের ফেরত পাঠানো হবে। এই বিল আনার বিষয়টি বিজেপির নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল। বিলটি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য বিরোধীদের দাবি মেনে সরকার জেপিসি গঠন করে। লোকসভার ২০ ও রাজ্যসভার ১০ সদস্যকে নিয়ে গঠিত সেই জেপিসির বৈঠক ছিল আজ মঙ্গলবার। জেপিসিতে সংখ্যালঘু হলেও বিরোধীদের চাপে শেষ পর্যন্ত চেয়ারম্যান রাজেন্দ্র আগরওয়াল (বিজেপি) বৈঠক এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেন। বিরোধীদের অভিযোগ, বিজেপি চাইছে সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে বিলটি আইনে পরিণত করতে যাতে চলতি পাঁচ রাজ্যের ভোটে তার প্রভাব পড়ে এবং আগামী বছর লোকসভার নির্বাচনের আগে নতুন নাগরিকত্ব আইনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করা যায়।
এই খসড়া বিলের বিরোধিতায় কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টি ও বামপন্থীরা এক জোট। কিন্তু জোটবদ্ধ হলেও জেপিসিতে বিরোধীদের সংখ্যা রীতিমতো কম। জেপিসিতে লোকসভার ২০ সদস্যের মধ্যে বিরোধীদের সংখ্যা ৬, রাজ্যসভার ১০ সদস্যের মধ্যে ৪। বিজু জনতা দল ও এআইএডিএমকের মতো দলগুলো এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নেবে তা অজানা। কিন্তু তা হলেও, জেপিসির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্মতি বিলের পক্ষেই যাবে।
আজ বৈঠকের পর জেপিসিতে কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য প্রদীপ ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, বিজেপি যেনতেন প্রকারেণ এই বিলটি পাস করাতে চাইছে। আগুপিছু বিবেচনা না করেই। তিনি বলেন, ‘আমি যে সংশোধনী জমা দিয়েছিলাম, কমিটি তা বদলে দিয়েছে। নতুনভাবে সেই সংশোধনী ফের জমা দেব।’ তৃণমূল কংগ্রেসের লোকসভা সদস্য সৌগত রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সবাই একযোগে এই বিলের বিরোধিতা করেছি। বলেছি, এই বিল আইনে পরিণত হলে দেশে অন্য ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হবে।’ বৈঠকে অংশগ্রহণকারী অন্য এক সূত্রে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য ও অধীর চৌধুরীর সঙ্গে বিলের বিরোধিতায় যোগ দেন আসামের দুই কংগ্রেসি ভুবনেশ্বর কলিতা ও সুস্মিতা দেব। তৃণমূল কংগ্রেসের সৌগত রায় ও ডেরেক ও’ব্রায়ান, সিপিএমের মোহাম্মদ সেলিমের সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির সদস্যও বিলটির বিরোধিতা করেন। প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, চেয়ারম্যান চেয়েছিলেন বিলটির প্রতিটি ধারা আলোচনা করে মঙ্গলবারই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে। তাঁকে বলা হয়, এত তাড়াহুড়ার প্রয়োজন নেই। দেশের স্বার্থ খতিয়ে দেখা জরুরি।
সূত্র অনুযায়ী, গতকালের বৈঠকে বিরোধীদের দিক থেকে একটি প্রস্তাবে বলা হয়, অত্যাচারিতদের ক্ষেত্রে ধর্মভিত্তিক ভাগাভাগি তুলে দেওয়া হোক। অন্য একটি প্রস্তাবে বলা হয়, বিলটি থেকে ‘বাংলাদেশ’-এর নামটি বাদ দেওয়া হোক যেহেতু এই দেশ থেকে চলে আসা ‘অত্যাচারিতদের’ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন মত রয়েছে।
আসামের শাসক জোটও এই প্রশ্নে বিভক্ত। রাজ্যে বিজেপির শরিক অসম গণ পরিষদের (এজিপি) তিন মন্ত্রী, একজন সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং দুজন বিধায়ক মঙ্গলবার সংসদ ভবনে আলোচনা কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে জেপিসি সদস্যদের বোঝান, কেন এই বিল সমর্থন করা উচিত হবে না। দলীয় সূত্রের খবর, আসামে বিজেপি ছাড়া আর কোনো রাজনৈতিক দল এই বিলের পক্ষে নেই। বিলটি আইনে পরিণত হলে ওই রাজ্যে শাসক জোটে ভাঙন অনিবার্য হয়ে উঠবে।