ভারতে ডিজিটাল দৌড়ে লাখো মানুষ পিছিয়ে

ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

নাগরিকদের ডিজিটাল ক্ষমতায়নের কথা মাথায় রেখে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভোল পাল্টে দিতে ডিজিটাল ভারত কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল দেশটির সরকার। শহর-গ্রামনির্বিশেষে দেশবাসীকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া উদ্যোগটি আদতে গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে তেমন সুবিধা এনে দিতে পারেনি। বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে দেশটির ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিভাজনের চিত্র উঠে এসেছে।

ভারতে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৬৩ কোটিরও বেশি। তবে ইন্টারনেট সুবিধা পাওয়া ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে প্রতি ১০০ জনে কমপক্ষে একজন আছেন, যিনি সত্যিকার অর্থে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না। সেই ব্যক্তির গ্রামাঞ্চলে বাস করার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

তবে ডিজিটাল ভারত নিয়ে খুশি হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

গ্রাহকসংখ্যার দিক থেকে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। এ সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার মোট জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। এখানে মোবাইল ডেটার দামও খুব সস্তা। যার কারণে গত চার বছরে বিশাল এক জনগোষ্ঠী সহজে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পেরেছে।

গ্রাহকসংখ্যার সঙ্গে ডেটা ব্যবহারও সমানতালে বাড়ছে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা এখন প্রতি মাসে গড়ে ৯ গিগাবাইটেরও বেশি ডেটা খরচ করেন। এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক ই-বাণিজ্য বাজার, ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ভিডিও স্ট্রিমিং শিল্প এবং সাশ্রয়ী মূল্যে ডিভাইস পছন্দ করার মতো ইতিবাচক বেশ কিছু ক্ষেত্র বেড়ে উঠছে।

ডিজিটাল ভারত কর্মসূচিতে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সরকারি প্রশাসন সংস্কার করলে বিভিন্ন পক্ষের জন্য হরেক রকম সুযোগ-সুবিধা জোগানো সম্ভব। এ ধরনের সংস্কারের মাধ্যমে সরকারি প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা, কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা বাড়ে। আমলাতান্ত্রিকতার জট কমে। যোগাযোগ ও সমন্বয়ের উন্নতি হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এর ফলে সর্বত্র ও সব সময় নাগরিক-কেন্দ্রিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর সরকারি পরিষেবার জোগান ও প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যায়। তবে পুরো ব্যাপারটিই ক্রমাগত ডিজিটাল বিভেদের বাস্তবতায় আটকে আছে।

ডিজিটাল বিভেদ বলতে যাঁদের ইন্টারনেট এবং অন্যান্য ডিজিটাল প্রযুক্তিতে অ্যাকসেস রয়েছে এবং যাঁদের নেই—তাঁদের মধ্যকার ব্যবধানকে বোঝায়। কোনো ব্যক্তির অবস্থান, আয়, লিঙ্গ, শিক্ষা, ভাষা ও বয়সের ওপর ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার বা অ্যাকসেস নির্ভর করে।

টেলিকম রেগুলেটরি অথোরিটি অব ইন্ডিয়ার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ইন্টারনেট ঘনত্ব ৪৮.৪। মোট জনসংখ্যার প্রতি ১০০ জন ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যার ভিত্তিতে এই ঘনত্ব নির্ধারণ করা হয়।

দেশের ৬৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী গ্রামে বাস করলেও গ্রামীণ ইন্টারনেটের ঘনত্ব মাত্র ২৫.৩। সে তুলনায় শহরাঞ্চলের ঘনত্ব ৯৭.৯, যা গ্রামের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এর মানে ভারতের নাগরিকদের মধ্যে যাঁদের ইন্টারনেটে অ্যাকসেস রয়েছে, তাদের কমপক্ষে একজন ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারেন না। আর সেই ব্যক্তি সম্ভবত কোনো গ্রামাঞ্চলে বাস করেন।

ভারতের ২৮টি রাজ্য ও ৯টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলজুড়ে অ্যাকসেস স্তরে একেবারে ভিন্নতা দেখা যায়। উত্তরে বিহার ও উত্তর প্রদেশ এবং পূর্ব ওডিশার মতো রাজ্যগুলো মানব উন্নয়নের সূচকগুলোতে খুব একটা উন্নতি করতে পারেনি। ইন্টারনেট ব্যবহারের ঘনত্বের ক্ষেত্রেও তাদের অবস্থান উল্লেখযোগ্য নয়।

ভৌগোলিক অবস্থা ইন্টারনেটের অবকাঠামো পাওয়া না-পাওয়াকে প্রভাবিত করে।

ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হিমাচল প্রদেশের প্রত্যন্ত পার্বত্য অঞ্চল, রাজস্থানের কম জনবসতির মরুভূমি এবং মধ্য প্রদেশের ঘনবসতি অঞ্চল আরও বেশি করে ডিজিটাল বিভেদের সম্মুখীন হয়। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো ভারতের আদিবাসী ও প্রান্তিক সম্প্রদায়ের আবাসস্থল। ইন্টারনেটের দুর্বল সংযোগ অজান্তেই বিদ্যমান অসুবিধাগুলোকে টিকিয়ে রাখছে।

ডিজিটাল অ্যাকসেসের ক্ষেত্রে লিঙ্গ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মোবাইল অপারেটরদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থা জিএসএমএর ২০১২ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ১৬ শতাংশ ভারতীয় নারী মোবাইল এবং ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করছেন। তুলনামূলকভাবে নারীরা পুরুষদের চেয়ে মোবাইল ইন্টারনেট ৫৬ শতাংশ কম ব্যবহার করেন। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার পটভূমিতে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা নারী ইন্টারনেট ব্যবহারেও খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেননি।

অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়, মোবাইল ডেটার দাম মাত্রাতিরিক্ত হ্রাস পেলেও ইন্টারনেট ব্যবহার উপযোগী মুঠোফোনের দাম এখনো অনেকের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

আর্থিকভাবে নারীদের পরনির্ভরতা এবং বাড়িতে কর্তৃত্বের দিক থেকে নিম্ন অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এ জাতীয় ডিভাইস তাঁদের নাগালে পৌঁছাতে দেয় না। এ ছাড়া সাক্ষরতার স্বল্প হার এবং ডিজিটাল সচেতনতার অভাব নারীদের এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না। বয়স্ক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও এসব বাধা কাজ করছে।

সচেতনতা এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ক্ষেত্রে ডিজিটাল ক্ষমতায়নের কথা আলাদাভাবে বলতেই হয়। তবে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক শৃঙ্খলার জন্য অনেকে একে হুমকি মনে করছেন।

বেশ কিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, গ্রাম পর্যায়ের কয়েকটি সংস্থা নারীদের, বিশেষত অল্প বয়সী মেয়েদের মুঠোফোন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। অথচ ডিজিটাল ভারত প্রকল্পের অন্যতম প্রধান কর্মসূচি ছিল সবার জন্য মোবাইল সেবা নিশ্চিত করা। শিক্ষিত শ্রেণির কথা উঠলেও অনলাইন জগৎ থেকে গবেষণাগার পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে পুরুষেরাই রাজত্ব করে যাচ্ছেন। ভারত সরকার এসব সমস্যার হাত থেকে রেহাই পায়নি।

সরকার দেশের আড়াই লাখ গ্রাম কাউন্সিলে ব্রডব্যান্ড সংযোগ প্রদানের চেষ্টা করছে। ২০১১ সাল থেকে এ প্রকল্প কার্যকর হলেও এখন পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকেরও কম কাজ সম্পন্ন হয়েছে। সরকারের জাতীয় ডিজিটাল যোগাযোগ নীতি স্বীকার করেছে, এ ক্ষেত্রে আরও অনেক প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

প্রযুক্তি নীতিগবেষক স্মৃতি পারসিরা মনে করছেন, ডিজিটাল ভারত প্রকল্পে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। নীতিনির্ধারকদের একটি কঠোর ডেটাভিত্তিক পরিসংখ্যান চালানো প্রয়োজন। এতে সমাজের কোন স্তরের মানুষ ইন্টারনেট সুবিধা পাচ্ছে না এবং এর পেছনের কারণগুলো কী, তা নির্ণয় করা যাবে। ভারতের ডিজিটাল দৌড়ে প্রতিটি মানুষকে শামিল করতে সরকারের এখনই উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন স্মৃতি।