পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ নির্বাচনে বামেরা ঘুরে দাঁড়ানোর যে চেষ্টা করছিল, সেটা সফল হয়নি। তাদের এই ব্যর্থতাকে ভারতে বামপন্থার ব্যর্থতা হিসেবে দেখারও সুযোগ নেই। কারণ, একই সময়ের নির্বাচনে কেরালায় একই দলের লোকেরা আবারও ক্ষমতায় এসেছে। পাশের রাজ্য বিহারেও কয়েক মাস আগের নির্বাচনে বাম দলগুলো অতীতের চেয়ে অনেক বেশি আসন পেয়েছিল।
কেরালায় এবার বামেরা শুধু যে জিতেছে তা-ই নয়, কোনো সরকারের পুনরায় নির্বাচিত না হওয়ার যে ইতিহাস আছে ওই রাজ্যে, সেটাও বদলে দিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, কেরালায় যে দলকে মানুষ টেনে ধরে রাখছে, পশ্চিমবঙ্গে তাদের গড়া বামফ্রন্ট কেন বাঙালির বিরাগভাজন?
এই লেখা তৈরির সময় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের যে ফল দেখা যাচ্ছে, তাতে বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোট ২৯২ আসনের গণনায় মাত্র একটিতে এগিয়ে আছে। বামফ্রন্টের মুখ্য নেতা মুহম্মদ সেলিমও গণনায় পিছিয়ে রয়েছেন।
এই ফলাফল দেখে বোঝা শক্ত, ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বামফ্রন্ট জোট পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে। ১৯৭৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে ১০টা বিধানসভার নির্বাচন হলো। ২০১১ পর্যন্ত বামফ্রন্ট কখনো ৪০ শতাংশের কম ভোট পায়নি। অথচ এখন তাদের ভোটের হিস্যা তার অর্ধেক হয়ে গেছে।
১৯৭৭ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাতটি নির্বাচনে বামফ্রন্ট ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় কমবেশি ২০০ আসন পেয়েছে। ১৯৮৭ সালে সর্বোচ্চ ২৫১টি পেয়েছিল।
২০১১ থেকে তাদের বিপর্যয়ের শুরু ৬২ আসন পাওয়া দিয়ে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে পেল ৩২টি। এবার এখন পর্যন্ত বুথফেরত সমীক্ষায় বাম-কংগ্রেস মোর্চাকে কোথাও ২০ থেকে ২১টির বেশি আসন পেতে দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত সেটাও হয়তো মিলবে না। গণনার প্রাথমিক ইঙ্গিত সে রকমই। কংগ্রেস ও আব্বাস সিদ্দিকির নবগঠিত দলের সঙ্গে জোট করার পরও ফলাফলের এই অবস্থা
নির্বাচনী রাজনীতিতে জয়-পরাজয় দুটোই পালা করে আসে। জনভিত্তিসম্পন্ন দলগুলো ক্ষমতা হারিয়ে আবার তা ফিরেও পায়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের বেলায় দেখা যাচ্ছে, ২০১১ সালের বিপর্যয়ের পর তারা দ্বিতীয় অবস্থানও ধরে রাখতে পারছে না। রাজ্যের রাজনৈতিক পরিসরেই ক্রমে তারা তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ছে। যত নির্বাচন আসছে, তাদের অবক্ষয় কেবল নজরে পড়ছে।
২০১১ সালের পর লোকসভার দুটি নির্বাচন হলো। তাতে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ভোটের হিস্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ থেকে নেমে ৮ শতাংশে। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে তারা কোথাও দ্বিতীয়ও হলো না। ওই একই সময়ে দুটি বিধানসভা নির্বাচনে তাদের ভোটের হিস্যা কমে দাঁড়াল ৪১ থেকে ২৬ শতাংশে। এবার হয়তো আরও কমছে।
পশ্চিমবঙ্গে এবার ভোটের ফলে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছে বিজেপির রাজনীতি। বিজেপির মাধ্যমে আসা ধর্মবাদের সুনামি এখানকার সমাজে তীব্র মেরুকরণ ঘটিয়েছে। আরএসএস-বিজেপি হিন্দুপ্রধান একটা সমাজে হিন্দুত্ববাদকে যখন রাজনীতির প্রধান পণ্যে পরিণত করে, তখন বামদের শ্রেণি-রাজনীতি তাকে রুখতে পারেনি। বামফ্রন্ট ভেবেছিল, তাদের শ্রেণি-রাজনীতি ধর্মবাদী মেরুকরণকে অকেজো করে দেবে। সমাজে রুটিরুজির প্রশ্নই বড় হয়ে থাকবে। কিন্তু কার্যত তা হয়নি। বরং মমতার বাংলাপ্রেম শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ গড়েছে গেরুয়া সুনামির বিপরীতে। মমতা মাঠের বাস্তবতা বুঝেই তাঁর রাজনীতি সাজাচ্ছেন যতটুকু পারছেন বা পেরেছেন—কিন্তু বিমান বসুরা মাঠের মেরুকরণকে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব ধ্যানধারণাকেই সঠিক ভেবেছেন। তাতে রাজনীতির মাঠে নিজেদের বিশাল কর্মী বাহিনীকে অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলেছেন তাঁরা। বাম নেতাদের এ অবস্থা দেখেই মমতা মাঝেমধ্যে রসিকতা করে বলে ওঠেন, ‘আমিই প্রকৃত লেফট’! পরিবর্তনকে চট করে বোঝার ক্ষমতা বাম-বুদ্ধিমত্তার একটা জরুরি শর্ত হলে মমতা আসলে ভুলে বলেন না।
‘মালিক’-‘শ্রমিক’ পরিচয়ের বাইরে মানুষকে না দেখায় সমস্যা বেড়েছে
সমাজে পুঁজিপতি ও শ্রমিক পরিচয়ের ভেতরে-বাইরে আরও অনেক ‘পরিচয়’ নিয়ে মানুষ বাঁচে। রাজনীতি ও অর্থনীতির সঙ্গে সেসব পরিচয়েরও প্রতিনিয়ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটে বা ঘটতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বাম নেতারা এসবে বরাবর কম গুরুত্ব দিয়েছেন। শোষণমুক্তির ধারণাও সংকীর্ণ অর্থনৈতিক বিবেচনার বাইরে এসে চিন্তা করেননি তাঁরা। এটা অবিশ্বাস্য, ৩৪ বছর ক্ষমতায় থেকেও পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া, দলিত, মুসলমান প্রভৃতি পরিচয়ের মানুষ সিপিএম-সিপিআইয়ের অগ্রাধিকার তালিকায় ছিল না। অথচ এরা হতে পারত প্রকৃত বামপন্থার নিশ্চিত ভোটব্যাংক। এবারও দেখা গেল, ‘মালিক’ ও ‘শ্রমিক’—এই দুই পরিচয়ের বাইরে ভোটার খোঁজেনি বামপন্থা। ফলে ভোটাররাও এই তাত্ত্বিকদের এড়িয়ে গেছেন।
পশ্চিমবঙ্গে বামদের আজকের নির্বাচনী বিপর্যয় হঠাৎ সৃষ্ট নয়। অপ্রত্যাশিতও নয়। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণহীন থেকেছে তারা প্রথমবার ভোটার হওয়া তরুণ-তরুণীদের কাছে। এই রাজ্যে এবার প্রায় ২০ লাখ এ রকম ভোটার ছিল।
নতুন ভোটারদের আকর্ষণ করা দূরে থাক, বাম দলগুলো কম বয়সী কর্মীদেরও আটকে রাখতে হিমশিম খেয়েছে। এই জোট কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে ভোটে প্রার্থী করলেও তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। বহু আগেই ফ্রন্টভুক্ত দলগুলোয় তরুণদের আরও বেশি সংখ্যায় নীতিনির্ধারণী স্তরে জায়গা দেওয়া দরকার ছিল। সেটা না করায় অধিকাংশ বাম দলই বুঝতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের তরুণ সমাজ কী ভাবছে—কী চাইছে। নির্বাচনের আগের ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম নেতৃত্বে কোনো তরুণ-তরুণীরই অভিষেক ঘটেনি। দশকের পর দশক একই ‘নেতা’রা সেখানে একই ঢঙে কথা বলে গেছেন। কিন্তু ওপরে ওঠার রাস্তা বন্ধ দেখে দলের মধ্য ও নিচের সারির সংগঠকেরা তৃণমূল ও বিজেপিতে চলে গেছেন। এখন সেটা হয়তো আরও বাড়বে।
অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে বাম নেতৃত্বের আরেক বড় সমস্যা শত্রু-মিত্রের প্রায় চিরস্থায়ী এক ছকে আটকে থাকা। নির্বাচনী রাজনীতিতে এ রকম গোঁয়ার্তুমি অনেক সময় বন্দিদশা তৈরি করে। মমতার সঙ্গে লাল শিবিরের পুরোনো বিভেদ ছিল। কিন্তু সেই বিভেদের ফয়সালাকে বিজেপি-আরএসএসের সুনামির কালেও রাজনীতির প্রধান কর্তব্য করে রাখা স্থানীয় জনসমাজে সমর্থন পায়নি। রাজ্যের ভোটারদের বড় অংশ চাইছিল বামেরা এবার বিজেপিকে প্রতিরোধ প্রধান কর্তব্য হিসেবে নিক। বিহারে ওখানকার বামেরা কয়েক মাস আগে সে কাজই করেছিল। বিজেপিবিরোধী সব শক্তির সঙ্গে ঐক্য করার নীতি নিয়ে সেখানে তারা পুরোনো প্রতিপক্ষ যাদবদের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের সঙ্গে জোট করে। তাতে ফল হয়েছে এই, জোটের হিস্যা হিসেবে পাওয়া ২৯টি আসনের ১৬টিতেই তারা জিতেছে। কিন্তু বাংলায় বিজেপিবিরোধী মূল শক্তি তৃণমূলকে তারা প্রতিপক্ষের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারল না। অজ্ঞাত এক ভরসায় বামপন্থীরা এখানে ঐক্য করেছে কংগ্রেসের মতো চতুর্থ অবস্থানের দলের সঙ্গে, যা নির্বাচনী যুদ্ধে বড় কোনো মূল্যই সংযোজন করেনি। যে মানুষ বিজেপিকে ভোট দেয়নি, তারা বিজেপির প্রধান প্রতিপক্ষ তৃণমূলকে খুঁজেছে, তৃতীয় বা চতুর্থ কাউকে নয়। সিপিএম-সিপিআই বিহারে যে কৌশল নিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তা নেয়নি। দলটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার নেতৃত্বের এ রকম অবস্থান বিশাল এক প্রশ্নবোধক হয়ে আছে রাজ্যের অনেকের কাছে। ২০১৬ সালে একই রকম ঐক্য করেছিল কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের সঙ্গে। তাতে কোনো ইতিবাচক ফল আসেনি। সেই ব্যর্থতার স্মৃতি মাথায় রেখেও আবারও একই রকম ঐক্য করার মাধ্যমে এই জোটের উভয়শক্তি কী অর্জন করতে চেয়েছিল তা অবোধগম্যই থাকল।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের প্রধান শরিক সিপিএম। এই দলের গত ১০ বছরের উপলব্ধির একটা বড় জায়গা ছিল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে ভুল করেছে। নিশ্চয়ই একসময় এই মানুষেরা আবার কাস্তে-হাতুড়িতে ছাপ দেবে। এ মনোভাবের সারকথা হলো ‘আমাদের কোনো ভুল নেই, আমাদের কোনো পরিবর্তনের দরকার নেই—পাল্টাতে হবে ভোটারদের’। সিপিএম মনে করেছে, তৃণমূলের প্রতি মোহভঙ্গের পর আবার পুরোনো ভোটাররা তাদের সমর্থক হয়ে উঠবে।
এ রকম একরোখা জবাবদিহিহীন মনোভাবের ভেতর যে ঔদ্ধত্য থাকে, তা ভালোভাবে নেয়নি মানুষ। রাজনীতি যাঁরা করবেন, বিশেষভাবে যাঁরা পরিবর্তনবাদী আদর্শের কথা বলবেন, তাঁদের যেকোনো বিপর্যয়ের কারণ খুঁজতে হয় জনতার সঙ্গে নতুন করে সংলাপে বসে। সমাজ যেহেতু সদা পরিবর্তশীল, সে কারণে রাজনীতির মানুষদের পরিবর্তনহীন অনড় মনোভাব নিয়ে বসে থাকলে নিশ্চিতভাবেই পিছিয়ে পড়তে হয়। পশ্চিমবঙ্গে গত দু–তিন দফা ভোটে বামফ্রন্টের জন্য তা–ই ঘটল। অথচ কোনোকালে বামপন্থী দল না করেও মমতা প্রতিনিয়ত ক্ষমতা ধরে রাখার স্বার্থে তাঁর কলাকৌশলে পরিবর্তন এনেছেন। জনগণের মনোভাবের সঙ্গে নিজের ভাবনাচিন্তাকে সমন্বয় করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর দল সেটার সুফল পেল।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক