ভারতে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির নেতা–নেত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যের পর ওঠা বিতর্ক সামাল দিচ্ছে ভারত সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সরকার বলছে, এসব মন্তব্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিজস্ব অভিমত। ভারত সরকারের মনোভাব নয়। ভারত সরকার সব ধর্মের প্রতি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধাশীল। মন্তব্য করা ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বিজেপি ইতিমধ্যে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।
বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র নূপুর শর্মা গত সপ্তাহে এক টেলিভিশন বিতর্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর স্ত্রী হজরত আয়েশাকে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এরপর বিজেপির দিল্লি শাখার গণমাধ্যমপ্রধান নবীন কুমার জিন্দাল মহানবী (সা.)–কে নিয়ে একটি টুইট করলে অনেকে ক্ষুব্ধ হন। পরে অবশ্য টুইটটি মুছে দেন জিন্দাল। নিজের বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন নূপুর শর্মাও।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে নিয়ে বিজেপির দুই নেতা–নেত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যের পর প্রথমে নিশ্চুপ ছিল দলটি। এমনকি ভারত সরকারও এ নিয়ে কিছু বলেনি। তবে দেশ–বিদেশে সমালোচনার ঝড় উঠলে নড়েচড়ে বসে সরকার। বিশেষত সৌদি আরব, ইরান, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েতের মতো মুসলিম দেশগুলো সমালোচনায় মুখর হলে আর চুপ থাকতে পারেনি দিল্লি। সমালোচনার মুখে নূপুর শর্মাকে সাময়িক আর জিন্দালকে দল থেকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে বিজেপি।
নূপুর–জিন্দালের বক্তব্যকে ‘অবমাননাকর’ বলে মন্তব্য করেছে সৌদি আরব। অন্যদের ‘বিশ্বাস ও ধর্মের প্রতি সম্মান’ জানানোর আহ্বান জানায় সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ জানিয়েছে কাতার, কুয়েত ও ইরান। কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পাকিস্তানও। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ টুইট করেছেন।
বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ঘটনায় বিবৃতি দিয়ে নিন্দা জানিয়েছে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)।
এসব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি। আজ সোমবার তিনি বলেন, বিজেপি নেতা–নেত্রীর মন্তব্য ব্যক্তিগত অভিমত; সরকারের মনোভাব নয়। তিনি আরও বলেন, ওআইসি সচিবালয়ের দেওয়া বিবৃতি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুরভিসন্ধিমূলক। কায়েমি স্বার্থান্বেষীদের মদদে তাদের এ বিভাজন কর্মসূচি।
পাকিস্তানের প্রতিবাদের বিষয়ে অরিন্দম বাগচি বলেন, পাকিস্তান ধারাবাহিকভাবে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করে আসছে। দেশটিতে হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান ও আহমদিয়াদের ওপর সুপরিকল্পিত অত্যাচারের সাক্ষী পুরো পৃথিবী। ভারত সরকার সব ধর্মকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করে।
ভারতের উপরাষ্ট্রপতি ভেঙ্কাইয়া নাইডু এখন কাতার সফরে রয়েছেন। এর মধ্যেই ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে বিজেপি নেতা–নেত্রীর মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে দেশটির সরকার। কাতার জানিয়েছে, পুরো বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাইতে হবে ভারতকে। একই দাবি কুয়েত, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও ওমানের।
ভারত সরকারের আশঙ্কা, মহানবী (সা.)–কে নিয়ে বিজেপি নেতা–নেত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যে আরব বিশ্বের সঙ্গে দিল্লির কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হতে পারে। কেননা, এসব দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক দেওয়া হয়েছে। অনেক বিপণিবিতান থেকে ভারতীয় পণ্য সরিয়ে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা। মধ্যপ্রাচ্যে ৬৫ লাখ ভারতীয় কাজ করেন। এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের প্রতিবছর ৯০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হয়। দূরত্ব তৈরি হলে এসব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বাণিজ্যে প্রভাব পড়বে।
তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সম্পর্কে অবনতির চাপ সামলানোর বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে দিল্লি। কাতারে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল রোববার এক বিবৃতিতে বলেন, মহানবী (সা.)–কে নিয়ে করা মন্তব্য সরকারের মনোভাবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণও নয়। এসব মন্তব্য যাঁরা করেছেন, শাসক দলের সংগঠনে তাঁরা বেশ ছোট পদে ছিলেন।
এ ছাড়া মুসলিম দেশগুলোর ক্ষোভ ও বিতর্ক যাতে না বাড়ে, সেদিকে বিশেষ নজর দিতে এসব দেশে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের সজাগ থাকার নির্দেশনা দিয়েছে দিল্লি। মহানবী (সা.)–কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য অনভিপ্রেত ও অসমর্থনযোগ্য, ভারতের এ অবস্থান মুসলিম দেশগুলোকে বোঝানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
শুধু বিদেশে নয়, দেশের ভেতরেও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। বিরোধী দল কংগ্রেস বলেছে, বিজেপি ধোঁকা ছাড়া আর কিছু দিচ্ছে না। সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করার যে দাবি তারা করছে, তা নির্ভেজাল অসত্য ও ধোঁকা। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেন, বিজেপি যা করেছে তা হলো ‘প্রথমে অপকর্ম করতে উসকানি দাও। তারপর ভালো সাজতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নাও।’
কংগ্রেসের সংসদ সদস্য শশী থারুর টুইটে বলেন, দেশে ধর্মান্ধতার শিক্ষা দিলে, বিদেশে ফলভোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। শাসক দলের সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও দায়িত্বজ্ঞানহীনতার জন্য বিদেশে ভারতের উঁচু মাথা নিচু হয়ে গেছে।
হায়দরাবাদের এআইএমআইএম নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি নূপুর শর্মাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করার দাবি তুলেছেন। তেলেঙ্গানার মন্ত্রী কে টি রাম রাও প্রশ্ন তুলেছেন, ধর্মান্ধ বিজেপি নেতাদের অপকর্মের জন্য ভারত কেন ক্ষমা চাইবে? ক্ষমা চাইতে হবে বিজেপি নেতাদের। হিংসার বিষ ছড়ানোর অপরাধে বিজেপিকে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।