ভারতের সাবেক কূটনীতিকদের ধারণা, বিজেপির বিপুল জয়ের ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে বকেয়া সমস্যাগুলোর সমাধান সহজতর হবে।
বিজেপির বিপুল জয় বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে আরও দৃঢ়ই শুধু করবে না, বকেয়া সমস্যাগুলোর সমাধান সহজতর করে তুলবে। যেমন, তিস্তা চুক্তি। ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পর্যবেক্ষকদের ধারণা এমনই।
তবে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব বিলের পরিবর্তন নিয়ে এই মহল কিছুটা সংশয়ী। তাঁরা মনে করেন, দ্বিতীয় দফায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর সরকারের উচিত এই দুই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যাবতীয় দুশ্চিন্তা দূর করা, যাতে প্রতিবেশী দেশে সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি না হয়।
তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ক্ষেত্রে মনমোহন সিং ও নরেন্দ্র মোদি কেউই সফল হননি। রাজ্যকে এড়িয়ে চুক্তি স্বাক্ষরেও তাঁদের অনীহা ছিল। এবারের নির্বাচন সেই অন্তরায় দূর করার পথে অনেকটাই সহায়ক হতে চলেছে বলে ধারণা। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মুচকুন্দ দুবে ও দেব মুখার্জি মনে করছেন, ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্ষমতায় এলে এযাবৎ অধরা তিস্তা চুক্তি ধরা দেবে। শনিবার প্রথম আলোকে মুচকুন্দ দুবে বলেন, অবশ্যই লোকসভার ফল এ ক্ষেত্রে সোনালি ঝিলিক। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুনভাবে উদ্যমী হবেন। দেব মুখার্জির মতে, লোকসভা ভোটে মমতার ক্ষমতা হ্রাস তিস্তার জন্য বাংলাদেশের কাছে ইতিবাচক।
আরেক সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ডানা ঝাপটানো অবশ্যই তিস্তা চুক্তির পক্ষে সুখবর। আরও ভালো খবর উত্তরবঙ্গে বিজেপির প্রভাব বিস্তার। তিস্তা চুক্তিতে যেটুকু আশঙ্কা তা ওই উত্তরবঙ্গেই। এই ফলের পর সরকারের উচিত হবে তিস্তা নিয়ে নতুনভাবে উদ্যোগী হওয়া। বীণা সিক্রি এ বিষয়ে আরও বলেন, তিস্তাসহ উত্তরবঙ্গের সব নদীরই প্রবাহ কমছে। এ কারণে দুই দেশেরই উচিত কম পানির ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করা।
ভারতের ‘ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালিসিস’–এর স্মৃতি পট্টনায়ক অবশ্য মনে করেন, তিস্তা চুক্তি সই করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ক্ষমতাসীন হওয়া জরুরি। না হলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে কেন্দ্রের সংঘাত অনিবার্য। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে শনিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এমনিতে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করা কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ। পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি উপেক্ষা করে মনমোহন বা মোদি তিস্তা চুক্তি সই করতে পারতেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষার তাগিদে তা তাঁরা করেননি। এবারও জোর করে মোদি কিছু করতে চাইবেন বলে মনে হয় না। স্মৃতি এ প্রসঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির উদাহরণ দেন। বলেন, ওই চুক্তি নিয়ে বিজেপির আসাম শাখার প্রবল আপত্তি ছিল। কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে সেই আপত্তি তিনি দূর করেছিলেন। তিস্তার ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয়নি বিরুদ্ধ দল পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকায়। অতএব মোদি ২০২১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবেন বলে স্মৃতির ধারণা।
বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী এবং সাবেক কূটনীতিক রাজীব ভাটিয়াও মনে করেন, লোকসভার এই ফলের পর তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের আশান্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। প্রথম আলোকে পিনাকরঞ্জন বলেন, তাঁর আশা, বরফ ক্রমেই গলতে শুরু করবে। মমতার ফল যথেষ্ট খারাপ হয়েছে। আগামী দিনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে আরও আগ্রাসী ভূমিকা নেবে। এই চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী তিস্তার মীমাংসা করতে পারেন। ভোটের আগে রাজীব ভাটিয়া পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু সময় কাটিয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সঙ্গে বিজেপির সর্বস্তরে সম্পর্ক আরও খারাপ হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর সহযোগিতার প্রশ্নও উঠবে না। ২০২১ সালে রাজ্যে পালাবদল ঘটলে তখন অন্য কথা।
তিস্তা ছাড়া অন্য যে দুই বিষয় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ছায়া ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তার একটি হলো জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) তৈরি। অন্যটি নাগরিকত্ব বিলে সংশোধন এনে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দানের প্রস্তাবটি। দুটি বিষয়ই বিজেপির মূল ইস্যু। তবে মুচকুন্দ দুবে মনে করেন, দুটি বিষয়ই অনেক বেশি ‘রাজনৈতিক’। রাজীব ভাটিয়া বলেন, ভোটের আগে মনে করা হয়েছিল এ দুটি বিষয়ের জন্য আসামসহ উত্তর–পূর্বাঞ্চলে বিজেপির ফল খারাপ হবে। অথচ তা হয়নি। বিজেপির উচিত দুটি বিষয় নিয়েই ধীরে চলা এবং বাংলাদেশকে আরও একবার আশ্বস্ত করা যে এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। দুবে ও ভাটিয়া দুজনেই মনে করেন, বাংলাদেশ শুধু বিশ্বস্ত বন্ধুই নয়, একমাত্র নির্ভরযোগ্য প্রতিবেশী। কাজেই, এই দুই বিষয় নিয়ে ভারত এমন কিছু করবে না, যা বাংলাদেশের পক্ষে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে ও সম্পর্ক খারাপ হয়।
এ বিষয়ে পিনাকরঞ্জন মনে করেন, অবৈধ অভিবাসন নিয়ে বাংলাদেশের উচিত ভারতের সঙ্গে বসা। দেব মুখার্জি মনে করেন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব বিল নিয়ে বিজেপি লক্ষ্য পূরণের দিকে এগোলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দুই দেশেই একটা অবিশ্বাসের বাতাবরণ সৃষ্টি হতে পারে। কারও পক্ষেই তা মঙ্গলজনক হবে না। দেব মুখার্জি এ প্রসঙ্গে ভারতের শাসক দল ও সরকারের মনোভাবের পার্থক্যটি মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, সরকার বারবারই বাংলাদেশকে বুঝিয়েছে, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু বিদেশি নাগরিকদের ‘পুশব্যাক’ করার দলীয় মনোভাব সরকারি মান্যতা পেলে বিষয়টি জটিলতা সৃষ্টি করবে। স্মৃতি পট্টনায়কের ধারণাও একই রকম। তিনি বলেন, এনআরসি ও নাগরিকত্ব, দুটি বিষয়েই ধর্মগত একটা সাযুজ্য রয়েছে। বিপদের জায়গাটা ওখানেই। যদিও বিদেশিদের ফেরত পাঠানো নিয়ে জবরদস্তি না হলে বাংলাদেশের চিন্তার কিছু নেই।
বীণা সিক্রি বিষয়টিকে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন, নাগরিকত্ব বিল সংশোধিত হলে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই যে বাংলাদেশ থেকে লাখে লাখে হিন্দুরা ভারতে চলে আসবে। আগে থেকে যাঁরা এসেছেন অথচ এখনো নাগরিকত্ব পাননি, যেমন পশ্চিমবঙ্গের মতুয়া সম্প্রদায়, এই বিলের লক্ষ্য তাঁদেরই মতো মানুষজন। বীণা এ বিষয়ে বলেন, বিলটি কার্যকর হলে স্বার্থান্বেষীরা বাংলাদেশের হিন্দুদের দেশ ছাড়তে বলবে, এমন ভাবনার কোনো কারণ নেই। বাংলাদেশের সরকার ও মানুষ নিজেদের স্বার্থেই দেশের অসাম্প্রদায়িক চরিত্র রক্ষায় উৎসাহী হবে।