৫০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজনীতি করেছেন ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই সময়ে অনেকবারই তাঁর রাজনৈতিক জীবন প্রায় খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেমনটা প্রায় সব রাজনৈতিক নেতারই হয়। তবে যেমন বিপদে তিনি পড়েছিলেন ১৯৮৬-র গ্রীষ্মকালে, তেমনটা বোধ হয় আর কখনোই পড়েননি, বলছিলেন সুখেন্দুশেখর রায়, বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ। ১৯৮৬-র গ্রীষ্মে প্রণব মুখার্জিকে কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে অন্য দল গড়তে হয়েছিল।
‘বেরিয়ে যেতে হয়নি। এটাই আপনাদের ভুল। ওনাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল’, ফোনের অপর প্রান্তে বললেন সুখেন্দুশেখর রায়।
‘কংগ্রেস কোনো কারণই দেখায়নি। এক লাইনে শুধু বলেছিল যে প্রণবদাকে বহিষ্কার করা হলো।’ এই বহিষ্কার ও তার পরের দুটি বছরকে প্রণব মুখার্জির জীবনের ‘কালো দিন’ হিসাবে চিহ্নিত করলেন রায়, যিনি কার্যত ছিলেন মুখার্জির পরিবারের ‘ঘরের ছেলে’। ২০১১ সালের আগের বেশ কয়েকটি দশক সুখেন্দু রাজনীতি করেছেন প্রণব মুখার্জির পাশে থেকে। এমনকি কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জির দল, রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেসে। ১৯৮৭-র পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ২০০টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল প্রণব মুখার্জির রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস । ‘কিন্তু মাত্র দুটি আসনে আমাদের জমানত জব্দ হয়নি। অত্যন্ত মুষড়ে পড়েছিলেন’, বললেন রায়। কিন্তু ঠিক কী কারণে বহিষ্কার করা হয়েছিল প্রণব মুখার্জিকে?
‘কারণটা অজানা। বস্তুত কোনো কারণই তো দেওয়া হয়নি। কিন্তু যেটা ঘটনা, সেটা জানতে একটু পিছিয়ে যেতে হবে’, রায় বললেন।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত পছন্দের লোক ছিলেন প্রণব মুখার্জি। ১৯৭৩-এ প্রণব মুখার্জি কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ধীরে ধীরে ইন্দিরা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ নেতা ও উপদেষ্টায় পরিণত হন। আর এটাই দিল্লি ও কলকাতার নেতাদের পছন্দ হয়নি। ‘আমি এঁদের, এই প্রণববিরোধী নেতাদের -“গ্যাং অব ফোর” (Gang of four) বলি। দিল্লিতে ছিলেন দুই অরুণ—নেহেরু ও সিং। বলরাম জাফর ও মাখন লাল ফোতেদার। কলকাতায় প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, অজিত পাঁজা, গণিখান চৌধুরী আর অশোক সেন। এঁদের চক্রান্তের কারণেই প্রণবদাকে বহিষ্কার করেছিল কংগ্রেস। সঞ্জয় গান্ধী মারা যাওয়ার পর এঁরা বুঝেছিলেন রাজীব গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হতে হবে এবং হয়েও ছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী মারা যাওয়ার পর একটা সময় প্রণবদাকে কংগ্রেস ছাড়তে হলো’, বলছিলেন রায়।
তবে আরও একটা ইতিহাসের কথা অনেকে বলেন, প্রণব মুখার্জি নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যেটা রাজীব গান্ধী ভালো ভাবে নেননি। এই যুক্তি সুখেন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়; এই কারণে যে এ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হয়নি। ‘বিষয়টাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটা এমন রং দেওয়া হয়েছিলে, যাতে তা প্রণবদার বিরুদ্ধে যায়।’ তবে এর একটা সুবিধা পরবর্তী সময়ে হয়েছিল বলে রায় মনে করেন। ১৯৮৮ সালে কংগ্রেসে ফেরেন প্রণব মুখার্জি। ১৯৯১ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে ও নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হন। গোটা কেবিনেট কেমন হবে, কারা মন্ত্রী হবেন, সে সবই ঠিক করে দিয়েছিলেন প্রণব মুখার্জি। শুধু খালি রেখেছিলেন অর্থমন্ত্রীর পদটা। এটা ধরেই নিয়েছিলেন, অর্থমন্ত্রী হবেন তিনিই।
‘কিন্তু, মন্ত্রিসভা ঘোষণা হওয়ার আগেই উনি বললেন, “আমায় বাদ দিল।” আমি ওনার সঙ্গে ওনার দিল্লির বাড়িতেই ছিলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কী করে বুঝছেন? এখনো তো মন্ত্রিসভা ঘোষণাই হয়নি। উনি বললেন, “নিয়ম হলো যাঁরা মন্ত্রী হবেন, তাঁদের কাছে কেবিনেট সচিবের ফোন ভোরবেলায় চলে আসবে। বলা হবে, তালিকায় আপনার নাম আছে। সেই ফোন আসেনি।”’
‘এরপর দ্বিতীয়বার দেখলাম দাদা অত্যন্ত হতাশ, যেমনটা ছিলেন ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৮—এই সময়ে। তিনি প্রথমটায় নরসিমা রাওয়ের সঙ্গে দেখাও করতে চাননি, প্রধানমন্ত্রী ডাকা সত্ত্বেও। পরে যখন গেলেন তখনো বিপত্তি। রাও সাহেব প্রণবদাকে প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হওয়ার অনুরোধ করলেন। অথচ ১৯৮২ সালেই প্রণবদা এসবের মাথায় ছিলেন, হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। তিনি যাঁকে ১৯৮২ তেই রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর করেছিলেন, সেই মনমোহন সিংকে ১৯৯১ সালে অর্থমন্ত্রী করা হলো, প্রণবদাকে বাদ দিয়ে। এটাই হয়তো দাদা ভালোভাবে নেননি। ফলে প্ল্যানিং কমিশনেও যেতে চাইলেন না, ১৯৯১-তে।’
এই সময়ে একদিন প্রণব মুখার্জিকে বড়সড় একটা ভাষণই দিলেন সুখেন্দুশেখর রায়। ‘আমি বললাম, দেখুন, আপনি ১৯৮৬ থেকে ৮৮ দলের বাইরে ছিলেন, কোনো পদে ছিলেন না এবং তাতে কোনো লাভ হয়নি। আপনি মাঠের বাইরে থেকে খেলার লোক তো নন। খেলাটা মাঠে থেকেই খেলতে হবে। আপনি কি চান ১৯৮৬ আবার ফেরত আসুক? তবে আপনার অবশ্যই কমিশনে যোগ দেওয়া উচিত। উনি কিছু বললেন না। পরের দিন আমায় বললেন, “আমি ভেবে দেখলাম, তুই ঠিকই বলেছিস।” আমি অবশ্য এসব বলতে সাহস পেয়েছিলাম কারণ বৌদি আমার সঙ্গে ছিলেন।’
১৯৯১ সালে ডেপুটি চেয়ারম্যান হওয়ার পর ৯৩-তে প্রণব মুখার্জি ফিরলেন রাজ্যসভায়। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভাতেও ফিরে এলেন ১৯৯৫ সালে। যদিও এর পরবতী পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে কংগ্রেস নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় ক্ষমতা থেকে দূরেই রইলেন প্রণব মুখার্জি। ‘আসলে উনি সেভাবে সংগঠনের লোক তো ছিলেন না, ছিলেন প্রশাসক, নীতিনির্ধারক। ক্ষমতার বাইরে থেকে কাজ করাটা ওনার পক্ষে মুশকিলেরই ছিল কিছুটা’, বলছিলেন সুখেন্দুশেখর রায়।
তবে ক্ষমতার বাইরে থাকলেও ১৯৯৬ সালে যখন ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গার পানি চুক্তি হলো, তখনো নানান পরামর্শ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ সরকারকে প্রণব মুখার্জি সাহায্য করেছিলেন বলে জানালেন এক সাবেক কূটনীতিক। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ককে প্রণব মুখার্জি বরাবরই সুদৃঢ় রাখার পক্ষে ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ভারতের সংসদে তিনি জোরালো ভাষায় স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছেন। তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম খণ্ডে তিনি লিখছেন, ‘১৫ই জুন (১৯৭১)-এর বাজেট অধিবেশনে আমি রাজ্যসভায় বললাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া। এর জন্য বাংলাদেশের নির্বাচিত মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক, বলেছিলাম।… বলেছিলাম, আমি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছি। বলছি, সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃত দেওয়ার কথা। এই রাজনৈতিক সমাধানের সূচক হিসাবে আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশকে জিনিসপত্র দিয়ে সাহায্যের কথা, সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বার্থে।’
মনে রাখা দরকার, এটা ছিল ১৯৭১ সাল, প্রণব মুখার্জির তখনো কংগ্রেসে যোগ দেননি। বস্তুত, সংসদে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি ও সমাজনীতি—বিশেষত ১৯৬৯-এ দুই কক্ষের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল রদ—এই বিষয় নিয়ে প্রণব মুখার্জির ভাষণ ও পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়ে বিতর্কই ইন্দিরা গান্ধীকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন মধ্য ত্রিশের প্রণব মুখোপাধ্যায় কংগ্রেসে যোগ দিন। তিনি দিলেনও, ১৯৭৩-এ, যখন প্রণব মুখার্জির দল বাংলা কংগ্রেস মিশে গেল জাতীয় কংগ্রেসে। প্রণব মুখার্জি হলেন ডেপুটি মিনিস্টার তবে আবার ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সখ্যের কারণে বিপদেও পড়লেন ১৯৮৪-তে, তিনি মারা যাওয়ার পর।
বাংলাদেশর সঙ্গে সম্পর্কটা অবশ্য রয়েই গেল, সেই ১৯৭১ থেকেই। পরবর্তী সময়ে সেই সম্পর্ক আরও জোরদার হলো ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবার দিল্লিতে থাকতে শুরু করলেন। ‘সম্পর্কটা অনেকটাই ব্যক্তিগত হয়ে পড়ল ওই সময়ে’, বছর ১৫ আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন এই প্রতিবেদককে।
এই ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও প্রণব মুখার্জির বাংলাদেশের গুরুত্ব বুঝে সেই সম্পর্ককে কূটনৈতিক স্তরে আরও জোরদার করার কারণেই বাংলাদেশ মনে রাখবে তাঁকে, প্রকৃত বন্ধু হিসেবে। যে কারণে, দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন প্রণব মুখার্জি অসুস্থ শুনে বলছিলেন, গোটা বাংলাদেশই অসম্ভব খুশি হয়েছিল, যখন উনি রাষ্ট্রপতি হলেন।
‘একটা স্বাভাবিক, স্বচ্ছন্দ সৌজন্যবোধ ওনার ছিল, যেটার এই মুহূর্তে একটা অভাব আমরা বোধ করছি। এই সৌজন্যবোধই ওনাকে ভালোবাসার কারণ বাংলাদেশের’, বলেছিলেন তৌহিদ হোসেন। ভারতের রাজনীতিতেও প্রণব মুখার্জির গভীর বিরোধীরা প্রায় এক বাক্যে বলছেন, সৌজন্যবোধের অভাব প্রণব মুখার্জির রাজনীতিতে ছিল না, বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও।
এক অর্থে হয়তো ভদ্রতা ও সৌজন্যের রাজনীতিও শেষ হলো প্রণব মুখার্জির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে।