ভারতের পশ্চিমবঙ্গজুড়ে আবার মাওবাদী তৎপরতা শুরু হয়েছে। ওই এলাকায় মাওবাদী কার্যক্রম দুশ্চিন্তায় ফেলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে। ভারতে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে ৩৬টি। এর মধ্যে ১০টিতে মাওবাদী প্রভাব দেখা যায়।
পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বিহার, ঝাড়খন্ড, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্রিশগড়, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানায় মাওবাদী তৎপরতা রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের প্রভাব বেশি। জঙ্গলমহল হলো রাজ্যের জঙ্গল এলাকার তিনটি জেলা—পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতার হাতবদল হয়। ৩৪ বছরের বামফ্রন্টের শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বামফ্রন্টের শাসনের শেষের দিকে এই পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গলমহল ছিল মাওবাদীদের এলাকা। মাওবাদীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র তুলে নেয়। নেতৃত্ব দেন মাওবাদীদের কেন্দ্রীয় নেতা মাল্লজুলা কোটেশ্বর রাও ওরফে কিষেনজি। মাওবাদীদের তৎপরতায় অশান্ত হয়ে ওঠে জঙ্গলমহল। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাওবাদীদের পাশে দাঁড়ান। ঘোষণা দেন, তৃণমূল ক্ষমতায় এলে মাওবাদীদের সমস্যার সমাধান করবেন। ঘোষণার পর মাওবাদীরাও এসে দাঁড়ান মমতার পাশে। জয়ী হন মমতা।
২০১১ সালে ক্ষমতায় এসে মাওবাদীদের সমস্যার সমাধানে কাজ করেন মমতা। মুক্তি দেন কিছু মাওবাদীকে। বিভিন্ন আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করে মাওবাদীদের আত্মসমর্পণ করিয়ে অনেককে ফিরিয়ে আনেন। মমতার এ পদক্ষেপে জঙ্গলমহলে শান্তি ফিরতে শুরু করে। কিন্তু মাওবাদীরা এতে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনেক মাওবাদী নেতাকে মমতা মুক্তি দেননি। জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াই অব্যাহত থাকে। মাওবাদী নেতা কিষেনজি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নিহত হন। কিষেনজির মৃত্যুর পর কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়ে জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের তৎপরতা।
এখন জঙ্গলমহলের আদিবাসী সমাজে বঞ্চনার নানা অভিযোগ সামনে এনে ফের শুরু হয়েছে মাওবাদী তৎপরতা। মাওবাদীরা ফের বিভিন্ন ব্যানারে সংঘবদ্ধ হয়েছে। এ বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নামে মাওবাদীরা পঞ্চায়েত নির্বাচনে নামে। তারা জঙ্গলমহলের বেলপাহাড়ি, বাঁশপাহাড়ি, জামবনি লালগড়, রাইপুর এসব এলাকায় প্রার্থী দেয়। নির্বাচনে আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের বেশ কিছু প্রার্থী জয়ীও হন। বাঁকুড়ায় ১১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতে প্রার্থী দিয়ে জয়ী হয়েছে ৩০টি আসনে। পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরেও ভালো করেছে মাওবাদীরা। আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সভাপতি বাবলু মুর্মু ও সাধারণ সম্পাদক ধর্মাল মান্ডি।
হঠাৎ করে জঙ্গলমহলে মাওবাদী তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় চিন্তা বেড়েছে মমতার। এর পাশাপাশি সাঁওতালি ভাষার বিকাশ ও পাঠদানের দাবি তুলে মাওবাদীরা সম্প্রতি অশান্ত করে তুলেছিল জঙ্গলমহল। বিপর্যস্ত করেছিল রেলসেবা।
পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ বলছে, ২০১১ সালের আগে জঙ্গলমহলে মাওবাদীরা ‘পুলিশি–সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি’ নামে যে আন্দোলন শুরু করেছিল, এর অন্যতম নেতা ছিলেন ছত্রধর মাহাত। তিনি এখন বন্দী রয়েছেন কারাগারে। তিনি মুক্তি পাননি। ওই কমিটির সঙ্গে যুক্ত নেতারা ফের সংঘবদ্ধ হয়ে শুরু করেছেন আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চের নামে আন্দোলন।
আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চ প্রথম আত্মপ্রকাশ করে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রাক্কালে। রাজ্য পুলিশের গোয়েন্দারা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, সেদিনের পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটির অনেক নেতা এখন যোগ দিয়েছেন এই আদিবাসী সমন্বয় মঞ্চে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন দাগোমণি টুডো, সুন্দর মাঝি, পূর্ণিমা মুর্মু, অমিত মোহন, লক্ষ্মীরাম মুর্মু, নগেন্দ্র সরেন, সনু মুর্মু, জগন্নাথ সর্দার প্রমুখ।
পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদীদের তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য সার্বিক নজর রাখছে পশ্চিমবঙ্গের পার্শ্ববর্তী ঝাড়খন্ড রাজ্যের মাওবাদীরা। পশ্চিমবঙ্গেরও বহু মাওবাদী নেতা আত্মগোপন করে আশ্রয় নিয়েছে এই ঝাড়খন্ড রাজ্যে। এখানেই আছেন পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ মাওবাদী নেতা প্রশান্ত বসু ও আকাশ। মাওবাদীদের নতুন করে সংঘবদ্ধ হওয়ার বিষয়টিও পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ভাবিয়ে তুলছে।