নাগরিকত্ব সংশোধন বিল নিয়ে ভারতের শাসক দল বিজেপি উভয়সংকটে পড়েছে। একদিকে নীতি, আদর্শ ও প্রতিশ্রুতি, অন্যদিকে নির্বাচনী বিপর্যয়ের আশঙ্কা—এই জাঁতাকলে পড়ে বিজেপি দিশেহারা। পরিস্থিতির মোকাবিলায় কী করা যায়, শাসক দলে তীব্র দোলাচল তা নিয়েই।
লোকসভা ভোটের আগে ভারতীয় সংসদের সংক্ষিপ্ত বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে আজ বৃহস্পতিবার। প্রথাগতভাবে সংসদের দুই কক্ষের যুগ্ম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের যৌক্তিকতার উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রতিবেশী মুসলিম দেশগুলো থেকে অত্যাচারিত হয়ে যেসব অমুসলিম ভারতে আশ্রয়প্রার্থী, এই বিল পাস হলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া সহজতর হবে।
রাষ্ট্রপতি এই কথা যখন বলছেন, দেশের উত্তর–পূর্বাঞ্চল তখন এই বিল নিয়ে উত্তপ্ত। আসাম অগ্নিগর্ভ। সেখানে তিনসুকিয়া জেলার বিজেপি সভাপতি গতকাল বুধবার প্রহৃত হয়েছেন। আজ কালো পতাকা দেখানো হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে। বিলের বিরোধিতায় গোটা রাজ্যে বিক্ষোভ চলছে প্রতিদিন। বিজেপির শরিক অসম গণপরিষদ (অগপ) সরকার থেকে বেরিয়ে এসেছে। তীব্র বিরোধিতায় নেমেছে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু)। মেঘালয়, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা ও মিজোরামে বিলের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে বিজেপির শরিকেরা। ত্রিপুরায় বিজেপির জোটসঙ্গী আইপিএফটিও বিলের বিরোধিতা শুরু করেছে। এই সর্বব্যাপী প্রতিরোধে বিজেপি দিশেহারা। দিল্লিতে বিজেপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রতিবেদন এসেছে, বিল নিয়ে বিজেপি অনড় থাকলে গোটা উত্তর–পূর্বাঞ্চলের মোট ২৫টি লোকসভা আসনের মধ্যে বিজেপির ভাগ্যে একটিও জেতা সম্ভব হবে কি না সন্দেহ। নাগরিকত্ব বিলের আগে বিজেপির লক্ষ্য ছিল অন্তত ২০ আসন।
এই অবস্থায় কী করণীয়, তা নিয়ে বিজেপি দ্বিধাবিভক্ত। দলের যাঁরা সরাসরি আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত, তাঁরা মনে করেন, আদর্শ, নীতি ও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়। ত্রিপুরায় বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে বিজেপিকে প্রথমবার ক্ষমতায় আনতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস) যাঁকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই সংঘঘেঁষা সুনীল দেওধর প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই বিল নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে হবে দলকেই। বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুসহ অত্যাচারিত অমুসলিম নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়ার দায়িত্ব ভারতেরই। ভারত যদি তাঁদের সম্মানের সঙ্গে নির্ভয়ে বসবাস করার অধিকার না দেয়, তাহলে কারা দেবে? ভারতই গোটা পৃথিবীর অত্যাচারিত হিন্দুদের একমাত্র আশ্রয়স্থল। এই আদর্শ ও নীতি থেকে সরে আসা উচিত নয়।’
নীতি ও আদর্শের সঙ্গে বাস্তব রাজনীতির এই দ্বন্দ্ব কীভাবে মেটানো সম্ভব, এখনো তা নিশ্চিত নয়। তবে রাষ্ট্রপতির ভাষণ সরকারেরই তৈরি করে দেওয়া। আর তাতে নাগরিকত্ব বিলের উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিয়েছে, এখনই এই বিল থেকে সরকার সরে আসছে না। উত্তর–পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক রাম মাধব জানিয়েছেন, পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাঁরা দুইভাবে সচেষ্ট। সংগঠনের পক্ষে তিনি কথা বলছেন বিরোধীদের সঙ্গে, সরকারের তরফে আলোচনা চালাচ্ছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং। উত্তর পূর্বাঞ্চলের সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনার জন্য রাজনাথ সিং দিল্লিতে বৈঠক ডেকেছেন। বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে মাঝামাঝি কোনো এক মীমাংসা সূত্রে পৌঁছতে বিজেপি ব্যগ্র, যাতে লাঠি অটুট রেখে সাপ মারা যায়।
তবে পরিস্থিতি যা, তাতে উত্তর–পূর্বাঞ্চলের ক্ষোভ প্রশমিত হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং বিলের ও বিজেপির বিরোধিতার বহর দিন দিন বেড়েই চলেছে। লোকসভায় বিলটি পাস হলেও রাজ্যসভায় সরকার পক্ষ এমনিতেই কমজোরি। এর ওপর বিজেপির শরিক সংযুক্ত জনতা দল ও লোক জনশক্তি পার্টি বিলের বিরোধিতায় নেমেছে। কংগ্রেস রাজ্যসভায় তার সদস্যদের এ বিলের বিরোধিতা করার নির্দেশ দিয়েছে। বিজেপি জোরাজুরি করে রাজ্যসভায় বিলটি বিবেচনার জন্য আনলেও ভোটাভুটিতে তা পাস না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।