ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হবে আজ মঙ্গলবার। সই হবে ভূস্থানিক সহযোগিতামূলক ‘বেসিক এক্সচেঞ্জ অ্যান্ড কো–অপারেশন—বেকা’ চুক্তি, ভারত–চীন সীমান্ত উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে যা দুই দেশের প্রতিরক্ষা সম্পর্কের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া কূটনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে একাধিক চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সেই বৈঠকে যোগ দিতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার গতকাল সোমবার দুপুরে দিল্লি এসে পৌঁছান। সন্ধ্যায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বৈঠকে বসেন মাইক পম্পেওয়ের সঙ্গে। আজ হায়দরাবাদ হাউসে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর দুই দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁরা মিলিত হবেন। আনুষ্ঠানিক বৈঠকের পর যুক্তরাষ্ট্রের দুই মন্ত্রী দেখা করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক এক সপ্তাহ আগে এই বৈঠক কূটনৈতিক স্তরে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি করেছে। নির্বাচনের প্রাক্কালে এত বড় মাপের কূটনৈতিক পদক্ষেপের যৌক্তিকতা ও তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে, বিশেষ করে সম্ভাব্য নির্বাচনী ফল যখন দুই পক্ষের কাছেই অজানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও দুই দেশের কূটনৈতিক মহলের বিশ্বাস, রাজনৈতিক পালাবদল ঘটলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মৌলিকতায় কোনো পরিবর্তন ঘটবে না। ফলে পারস্পরিক স্বার্থে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে দুই দেশের কারও পক্ষেই অসুবিধা হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই সফর নিয়ে জারি করা এক বিবৃতিতে বলেছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের আগামী বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে পারস্পরিক বোঝাপড়া আরও বাড়াবে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনা উপস্থিতি জোরদার হয়ে উঠেছে। সফর শুরুর আগে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে পম্পেও বলেন, ‘ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া যেতে মুখিয়ে আছি। এই সহযোগীদের সঙ্গে একযোগে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর স্বাধীন, ভয়মুক্ত বিকাশে আমরা সচেষ্ট।’ গত মে মাসে ভারত–চীন প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং কোভিড পরিস্থিতিতে চীনের ‘সার্বিক সম্প্রসারণবাদের’ বিরুদ্ধে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার জোটবদ্ধতার (কোয়াড) নিরিখে এই বৈঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। ‘বেকা’ চুক্তির ফলে প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভূস্থানিক গোয়েন্দা তথ্যের সব ধরনের সাহায্য ভারত পাবে। এই সফর দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা বাণিজ্যেরও প্রসার ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
চীনের মোকাবিলায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছাকাছি আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কোন দিকে নিয়ে যাবে, এখনো অজানা। ট্রাম্প প্রশাসন ক্রমেই ভারতকে কাছে টেনেছে এবং সেই পারস্পরিক স্বার্থের বেশিটাই চীনকেন্দ্রিক। সেই কারণে মালাবার নৌ–মহড়ায় অস্ট্রেলিয়াও যোগ দিচ্ছে। ভূরাজনীতির এই বিন্যাস পূর্ব লাদাখে ভারতের অনড় অবস্থানের অন্যতম কারণ।
সম্ভবত সেই আলোয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত চীন সম্পর্কে ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের বিষয়টি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এবং সেটাও করেছেন গত রোববার উত্তর ভারতের দশেরা উৎসবের (বিজয়া দশমী) দিন। সংঘের অনুষ্ঠানে তিনি পরিবর্তিত সেই মনোভাবের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে চীনকে টপকে যেতে হবে। সেই সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে হবে প্রতিবেশীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, চীন ভেবেছিল পূর্ব লাদাখের ঘটনাবলি ভারতকে কুঁকড়ে দেবে। কিন্তু ভারত যে পাল্টা রুখে দাঁড়াবে, সেটা তারা কল্পনা করতে পারেনি।
প্রতিবেশীদের কথা বলতে গিয়ে ভাগবত বিশেষ করে বলেন বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারের নাম, যে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিতে চীন প্রবল আগ্রহী। ভাগবত বলেন, এই দেশগুলো শুধুই প্রতিবেশী নয়, এদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক হাজার হাজার বছরের। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি দেশেরই চরিত্র ও মানসিকতা এক। এসব প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর মধ্য দিয়ে ভাগবত সম্ভবত এটা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, সম্পর্কে টানাপোড়েন চলেছে। তা মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন।
চীনের মোকাবিলায় মোহন ভাগবত ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর কথা বলেছেন, মাইক পম্পেওও ভারত সফরের পর দক্ষিণ এশিয়ার সেই প্রতিবেশীদের কাছেই যাবেন। মার্কিন উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগান সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন। স্পষ্টতই চীনকে রুখতে ট্রাম্প প্রশাসনের চেষ্টার অন্ত নেই। নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে সফরের গুরুত্ব তাই এতটা।