পি কে হালদারসহ ছয়জনকে রিমান্ডে নিতে উত্তর ২৪ পরগনার একটি আদালতে আবেদন করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইডি।
বাংলাদেশে আর্থিক খাতে আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) ও তাঁর পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। গতকাল শনিবার সংস্থাটি এই ছয়জনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিতে পশ্চিমবঙ্গের একটি আদালতে আবেদন করেছে।
এর আগে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে পি কে হালদারের প্রাসাদোপম বাড়িসহ অনেক সম্পদের সন্ধান পায় ইডি। সংস্থাটি পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের সম্পদের সন্ধানে গত দুই দিনে অন্তত ১০টি স্থানে অভিযান চালিয়েছে। প্রধানত আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেআইনিভাবে ভারতে অর্থ পাঠানো, বিদেশে অর্থ পাচার এবং আইনবহির্ভূত সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত করছে ইডি। অবশ্য এ পর্যন্ত কতগুলো বাড়ি, জমি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের হদিস পাওয়া গেছে, তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য গতকাল রাত পর্যন্ত জানা যায়নি।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পি কে হালদার বাংলাদেশে আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন। ২০১৯ সালে তিনি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ভারতে যান, পরে কানাডায় পাড়ি জমান।
ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ ও বসবাস, বেনামে সম্পত্তি কেনা এবং আইনবহির্ভূতভাবে অর্থ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আনা—এসব অভিযোগে পি কে হালদার ও তাঁর পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে ইডি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট বা অর্থ পাচার আইনের ওপরে। তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদারের ব্যবসা দেখাশোনা করা তাঁর ভাই প্রাণেশ কুমার হালদার আছেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ইডি বলছে, পি কে হালদার নিজেকে শিবশংকর হালদার পরিচয় দিয়ে ভারতের একাধিক সরকারি পরিচয়পত্র, যেমন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর দপ্তরের পরিচয়পত্র পিএএন বা প্যান, নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ইত্যাদি জোগাড় করেছিলেন। পি কে হালদারের সহযোগীরাও একই কাজ করেছেন বলে জানিয়েছে ইডি।
ইডি গতকাল এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এই পরিচয়পত্র দিয়ে পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীরা ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় সম্পদ কিনেছিলেন। কলকাতার কিছু অভিজাত এলাকাতেও তাঁদের বেশ কয়েকটি বাড়ি রয়েছে। ইডি বাংলাদেশের তিন নাগরিক পি কে হালদার, প্রীতিশকুমার হালদার ও প্রাণেশকুমার হালদার এবং তাঁদের কয়েকজন সহযোগীর বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়েছে। পি কে হালদার বাংলাদেশে বহু কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত বলেও ইডি জানিয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাটির ভাষ্য, ‘এই টাকার বিরাট অংশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে পাঠানো হয়েছে।’
পি কে হালদার, তাঁর দুই ভাই প্রীতিশ ও প্রাণেশ হালদার এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুকুমার মৃধা—এই দুই পরিবারের ঠিক কী পরিমাণ সম্পদ কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে, তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে গতকাল উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগর শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পাঁচটি প্রাসাদোপম ভবনের খোঁজ পাওয়া যায়। এর বাজারমূল্য কয়েক শ কোটি টাকা।
অশোকনগরের তিন নম্বর রেলগেটে দাঁড়িয়ে বাজার কমিটির সভাপতি কৌশিক মুখার্জী বলেন, ‘এই বাজারের যে দোকানটি আপনি দেখছেন, যার নাম ইউনিক ফ্যাশনস, তার মালিক মৃধা পরিবার। শেখর সাহা নামে এক ওষুধ ব্যবসায়ীর কাছ থেকে এই দোকান কিনেছেন সুকুমার মৃধা। সেটি চালু ছিল। আরও কিছুটা এগিয়ে যশোর রোডের মানিকতলা বাজারে একটি ব্যাটারিচালিত রিকশার শোরুম ও গোডাউন পাবেন। শোরুমটি বেশ বড়, ব্যবসাও ভালো চলছে।’ সব মিলিয়ে কতগুলো বাড়ি ও জমি এই পরিবারের আছে, তা এখনই নির্দিষ্টভাবে বলা যাচ্ছে না বলে জানালেন কৌশিক।
উত্তর চব্বিশ পরগনার স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনেরও একই বক্তব্য। এক কর্মকর্তা জানালেন, পি কে হালদার ও মৃধা—এই দুই পরিবারই যথেষ্ট সম্পদশালী। ওই অঞ্চলে তাঁদের বেশ কয়েকটি বাগানবাড়িও রয়েছে।
গতকাল যে পাঁচটি বাড়ির খোঁজ পেয়েছে প্রথম আলো, সেগুলোর একটি অশোকনগর মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্গত ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের যশোর রোডের ‘রাজলক্ষ্মী ভবন’। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির প্রধান ফটক ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। তবে ফটকের ওপর দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে বিস্তীর্ণ জায়গা এবং আরও বেশ কয়েকটি ভবন রয়েছে।
এই বাড়ির উল্টো দিকে প্রায় ২০ বছর ধরে থাকছেন মৌসুমী সিংহ রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাড়িটি সম্ভবত পি কে হালদারের সহযোগী সুকুমার মৃধার। কিন্তু বেশ কয়েক বছর সুকুমার মৃধাকে এখানে দেখা যায়নি। তাঁর বড় মেয়ের স্বামী সঞ্জীব হাওলাদারকে দেখা যেত। সুকুমার মৃধা অতীতে এখানে এসেছেন। মৃধা পরিবার বছর দশেক আগে বাংলাদেশ থেকে এসে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন বলে জানান মৌসুমী।
উল্লেখ্য, সুকুমার মৃধা ও তাঁর মেয়ে অনিন্দিতা মৃধা বাংলাদেশে দুদকের মামলায় কারাগারে আছেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য, স্বপন মিস্ত্রি (বা মিত্র) নামে আরেক ব্যক্তি সুকুমার মৃধার সঙ্গে কাজ করতেন। একদিকে জমি-বাড়ি কেনা নিয়ে সুকুমার মৃধা পি কে হালদার পরিবারকে পরামর্শ দিতেন এবং অন্যদিকে স্বপন বেআইনি পথে অর্থ বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে নিয়ে আসতেন। জেলা পুলিশের বক্তব্য, এই প্রক্রিয়া ১০-১৫ বছর ধরে গোপনে চলছে, না হলে এই পরিমাণ সম্পত্তি কেনা সম্ভব ছিল না।
প্রতিবেশী সংগীতশিক্ষক বাচ্চু কর বলেন, ‘স্বপন ও তাঁর পরিবার কয়েক বছর আগে ওই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। তবে পাড়ার কারও সঙ্গে তাঁরা কখনো মেশেননি, ফলে নির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয় যে তাঁরা কারা।’ রাতারাতি এত বিশাল ভবন তাঁরা অন্য জায়গা থেকে এসে এখানে কীভাবে বানালেন, বিস্ময় নিয়ে এ প্রশ্ন তুললেন বাচ্চু কর।
প্রতিবেশীরা জানান, পি কে হালদারের সহযোগী হিসেবে প্রাণেশ হালদার ও সুকুমার মৃধা যাবতীয় জমি-বাড়ি কেনাবেচা করতেন। অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করতে তাঁরা বিভিন্ন সংগঠনকেও টাকা দিয়েছিলেন বলে কিছু মানুষের বক্তব্য। বিভিন্ন ক্লাব, পূজা, অনুষ্ঠানে তাঁরা টাকাপয়সা দিতেন বলে জানা যাচ্ছে। স্থানীয় এক সাংবাদিক বলেন, ‘সাধারণভাবে যখন কেউ বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসে বসবাস করতে শুরু করেন, তখন তাঁরা এই প্রক্রিয়াতেই অঞ্চলে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করেন।’
অশোকনগরের ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ভবনটিতে প্রাণেশ হালদার তাঁর পরিবার নিয়ে থাকতেন বলে কয়েকজন জানিয়েছেন। বাড়িটি গাছপালা ও বাগান দিয়ে ঘেরা। প্রায় আট ফুট উঁচু দেয়াল চারদিকে। বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না। অন্য দুটি বাড়ির একটির (স্বপন মিস্ত্রির বাড়ি) প্রধান ফটক সিলগালা করেনি ইডি। ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়িটি সিলগালা করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। প্রধান ফটকে একটি নোটিশও লাগিয়ে দিয়েছেন ইডির কর্মকর্তারা। এতে লেখা, ‘মানি লন্ডারিং আইন, ২০০২-এর ১৭ নম্বর ধারা এবং ১/এ উপধারা মোতাবেক ইডির ডেপুটি ডিরেক্টর রামধন ডাগর বাড়িটি সিল করলেন। আমি, এন কে মসা, ইডির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এই আদেশ বাস্তবায়িত করলাম। যথাযোগ্য অফিসারের অনুমতি ছাড়া এই বাড়ি কেনাবেচা করা যাবে না।’
বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকে থাকেন ৭০ বছরের বাদল চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘কোন বাড়ির কে মালিক, কোনটা বেনামে রয়েছে, কোনটা সঠিক কাগজপত্র রয়েছে, এই ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আমরা শুধু দেখতাম, কিছু লোক বাড়িটিতে ঢুকছেন এবং বেরোচ্ছেন। এই বাড়িটি প্রাণেশ হালদারের, তাঁর মা লীলাবতীর, না সুকুমার মৃধার, তা আমি বলতে পারব না।’
স্থানীয়দের বক্তব্য, এ অঞ্চলে যাঁরা বাড়ি ও জমি কেনাবেচা করেন, তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বললে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের পক্ষে প্রকৃত চিত্র জানা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে দুদক সূত্রে জানা গেছে, পি কে হালদারের দখল করা চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি ও তাঁর স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করেন।
দুদক পি কে হালদারের প্রায় এক হাজার কোটি টাকা মূল্যের জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক করেছে। এ ছাড়া পি কে হালদার ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩৪টি মামলা করেছে দুদক। এসব মামলায় পি কে হালদারসহ আসামি ৮০ জন। এর মধ্যে ১২ জন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
দুদকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের তো ভালোই লাগল। একটা আসামি ধরা পড়ল। এখন আমরা তাঁকে দ্রুত দেশে আনার চেষ্টা করব। এটাই আমাদের একমাত্র কাজ।’
তবে দুদকের কোনো অভিযোগ বা আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ অভিযান হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করতে পারেনি কেউ।
যদিও দুদক গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পি কে হালদারের পাচারকৃত সম্পদের তথ্য চেয়ে দেড় বছর আগে কানাডা, সিঙ্গাপুর ও ভারতে পারস্পরিক আইনগত সহায়তা অনুরোধ (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট—এমএলএআর) পাঠায়। একই সঙ্গে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়। বাংলাদেশ পুলিশের এনসিবি ইন্টারপোল শাখার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করে ইন্টারপোল। আবেদনে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা এবং অভিযোগ সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ ছিল।