বিতর্কের মধ্যেই তাজমহলের ২২টি বন্ধ কুঠুরির কয়েকটির ছবি প্রকাশ করেছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (এএসআই)। কুঠুরিগুলোতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে—এমন দাবি যে সঠিক নয়, তা প্রমাণ করতেই এই ছবি প্রকাশ করা হয়। খবর টাইমস অব ইন্ডিয়ার।
সংরক্ষণ কাজের জন্য চলতি বছরের জানুয়ারিতে এসব বন্ধ কুঠুরি খোলা হয়েছিল। ভূগর্ভস্থ এই কুঠুরিগুলো সব সময় বন্ধ থাকে বলে দাবি করা হয়ে থাকে।
বন্ধ কুঠুরিগুলোতে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে কি না, তা জানতে চেয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্মৌ বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার ‘জনস্বার্থে’ একটি মামলা করে। মামলাটি করেন ক্ষমতাসীন বিজেপির অযোধ্যার মিডিয়া ইনচার্জ রজনীশ সিং।
তবে মামলাটি খারিজ করে দেন আদালত। শুধু মামলা খারিজই নয়, দুই বিচারপতি ডি কে উপাধ্যায় ও সুভাস বিদ্যার্থী মামলাকারীকে ভর্ৎসনা করে বলেন, জনস্বার্থ মামলাকে এভাবে উপহাসে পরিণত করবেন না। ক্রুদ্ধভাবে তাঁরা বলেন, ‘এরপর তো আমাদের চেম্বার খুলে দেখতে চাওয়া হবে, কী রয়েছে!’
ইউনেসকো–ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য তাজমহল পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। এই স্থাপত্যের অন্দরে ২২টি প্রকোষ্ঠ স্থায়ীভাবে বন্ধ রয়েছে। মামলার আবেদনে বলা হয়, সেই কুঠুরিগুলো খোলা হোক। দেখা হোক তার অভ্যন্তরে কী কী আছে।
মামলার আবেদনকারীর স্পষ্ট দাবি, আজ যার পরিচয় তাজমহল, তা আসলে ‘তেজো মহালয়’ নামের এক প্রাচীন শিবমন্দির, যার ওপর নির্মিত হয়েছে তাজমহল। তাঁর আবেদন ছিল, তাজমহলের ‘প্রকৃত ইতিহাস’ অনুসন্ধানে দায়িত্ব দেওয়া হোক এএসআইকে। পরীক্ষা করে দেখা হোক, কোনো হিন্দু মন্দিরের কাঠামোর ওপর মোগল সম্রাট শাহজাহান এই বিস্ময়কর স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন কি না।
১৩ মে এএসআইর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাজমহলের মূল কাঠামোর নিচের ওই কক্ষগুলো ‘সব সময় বন্ধ থাকে না’। এসব কক্ষে কোনো দেবদেবীর মূর্তি নেই।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বহু নথি ও প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এখন পর্যন্ত এসব কুঠুরিতে কোনো হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি থাকার অস্তিত্ব মেলেনি।
স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি রক্ষার্থে সম্রাট শাহজাহান ১৬৩১ সালে যে কাজে হাত দিয়েছিলেন, ২২ বছর ধরে ২২ হাজার শ্রমিকের উদয়াস্ত পরিশ্রম শেষে তা শেষ হয় ১৬৫৩ সালে। সেই বিস্ময়-স্থাপত্য তাজমহলকে ঘিরে বিতর্ক অবশ্য এই প্রথম নয়। ২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশের একদল আইনজীবীও এ নিয়ে মামলা করেছিলেন। তাঁদেরও দাবি ছিল, তাজমহল আসলে এক শিবমন্দির।
২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের কট্টরপন্থী বিজেপি নেতা বিনয় কাটিয়ার মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের কাছে দাবি জানিয়েছিলেন, তাজমহলের অভ্যন্তরে কোনো হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে কি না খতিয়ে দেখতে। ২০১৯ সালে কর্ণাটকের বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে দাবি করেন, শাহজাহান নাকি আদৌ তাজমহল তৈরি করেননি। ওটা তিনি কিনেছিলেন রাজা জয় সিংয়ের কাছ থেকে।
ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে পুরাতত্ত্ববিদেরা কেউই কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে সহমত হননি। ২০১৮ সালে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া আগ্রা কোর্টে এক হলফনামা পেশ করে জানিয়েছিল, শাহজাহানই তাজমহলের নির্মাতা।
এমন সময় তাজমহল নিয়ে আবার বিতর্ক তোলা হলো যখন উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা আইন অগ্রাহ্য করে বারানসির কাশী বিশ্বনাথ মন্দির ও মথুরার কৃষ্ণ জন্মভূমি ‘উদ্ধার’ করতে নব উদ্যোগে নেমেছেন। কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরলাগোয়া জ্ঞানবাপী মসজিদের অভিন্ন দেয়ালে খোদাই করা হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি বছরভর পূজা করার অধিকার দাবি করে এক আবেদন করা হয়েছিল বারানসি আদালতে।
বিচারক আবেদন মেনে মসজিদের অভ্যন্তরের জরিপের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিডিওগ্রাফ করার কথাও বলা হয়েছিল। সে জন্য কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁরা ভিডিওগ্রাফের কাজ সম্পন্ন করেছেন। এদিকে মসজিদের ওজুখানায় শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে এমন দাবি তোলার পর আদালতের নির্দেশে স্থাপনাটির ওই অংশে প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
ক্ষমতাসীন বিজেপির মাতৃসংগঠন সংঘ পরিবারের ঘোষিত কর্মসূচির অন্যতম অযোধ্যা, কাশী ও মথুরার ‘শৃঙ্খলমোচন’। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির হচ্ছে। কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদের জরিপের কাজ সেই লক্ষ্যে এক কদম এগোনো বলে বিজেপি মনে করছে। প্রস্তুতি চলছে মথুরার শ্রীকৃষ্ণ জন্মস্থানের লাগোয়া শাহী ঈদগাহ মসজিদের জরিপেরও।