ভারতনিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের বাজারঘাট-দোকানপাট, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাহারা বসিয়েছে। শুধু চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য সীমিত পরিমাণে গাড়ি চলাচলের সুযোগ রয়েছে। ভারত এত দিন যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তাতে কাশ্মীরের নাগরিকদের চোখেমুখে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এর একটি হতাশার, আরেকটি আশার। কিন্তু গত মঙ্গলবার দিল্লি লোকসভায় যে বিলটি পাস হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হয়েছে। রাজ্য বাতিল করে কেন্দ্রশাসিত দুটি অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে কাশ্মীরকে। এর ফলে তাদের চোখেমুখে যে অভিব্যক্তি দেখা যাচ্ছে, তা হলো পরাজয়ের।
কাশ্মীরের শ্রীনগরের বাসিন্দা সাইদ খান। ইলেকট্রনিক প্রকৌশলী তিনি। সাইদ খান বলেন, ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমাদের মতামত জানতে চাওয়ার মতো কোনো চুক্তি কি আর আছে?’ কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর এখন ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। এই শহরের অনেকেই এখন সাইদ খানের মতো করে ভাবছেন।
গত রোববার থেকেই কাশ্মীরের ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, টেলিফোন লাইন বন্ধ, বন্ধ মুঠোফোন নেটওয়ার্কও। সেখানে বাড়তি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে শ্রীনগর দৃশ্যত অবরুদ্ধ শহর। সাইদ খান বলেন, ‘সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। স্বাধীনতাকামীরা কারাগারে। কোনো আন্দোলন ছিল না, বিদ্যালয়গুলো খোলা ছিল, দোকানপাট খোলা ছিল, পর্যটকের আগমনও বেড়েছিল। সবাই খুশি ছিল। তারপর এক ঝাপটায় তারা সব কাশ্মীরির শত্রুতে পরিণত হলো। আমি জানি না ঠিক কীভাবে হলো।’ সাইদের বন্ধু এসবের জন্য ঔদ্ধত্যকে দায়ী করেছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘ক্ষমতার নেশায় মাতাল এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা আমাদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে পারেননি। এই ঘটনার ফলাফল তাদের বয়ে বেড়াতে হবে না, আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।’
শ্রীনগরের সারাইবাল এলাকার বাসিন্দা ইমতিয়াজ উনওয়ানি। স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি। ইমতিয়াজ বলেন, ‘রাজনীতির আবরণে ঢাকা একটি আগ্নেয়গিরি কাশ্মীর। তারা ওমর আবদুল্লাহ ও মেহবুবা মুফতিকে গ্রেপ্তার করেছে। এখন এমএলএ রশিদকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করছে। এই ব্যক্তি আমাদের প্রায়ই বলতেন, “ইটপাটকেল নিক্ষেপ কোরো না।” আর এখন এই অবস্থা। তারা আগ্নেয়গিরির আবরণ খুলে ফেলেছে।’ সেখানকার এক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি সরকারি কর্মচারী। আমি আদেশ মেনে চলব। কিন্তু আমি আমার সন্তানকে কী বলব? আমি কীভাবে তাকে বোঝাব, ভারত তোমাকে নিয়ে ভাবছে এবং তুমি বিক্ষোভে যেয়ো না। ছোট ছেলে এখনই বলা শুরু করেছে, মৃত্যু যখন হবেই, তখন স্কুলে গিয়ে কী হবে?’
শ্রীনগর যাওয়ার পথে কাশ্মীরের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা জানান, তাঁর বড় ছেলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন আর ছোট এক ছেলে মালয়েশিয়ায়। এই ঘটনা শোনার পর বড় ছেলে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে বলছেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমার মেয়ে শ্রীনগরে থাকে। দুই দিন ধরে তার সঙ্গে কথা বলতে পারছি না।’ কথা হয় জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তরের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত তিনি। এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি পড়াশোনা শেষ করে কাশ্মীরের কোনো একটি কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত হলো। ফলে, এই সম্ভাবনা আর নেই। কাশ্মীরে আর কোনো চাকরিও নেই। এর মধ্য দিয়ে তারা দেখিয়ে দিল, তারা আসলে কাশ্মীরের জমিন চায়, জনগণকে নয়।’