ভারতে কয়েক দিন ধরেই ২৪ ঘণ্টায় সাড়ে তিন লাখের বেশি করোনা রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে গড়ে সাড়ে তিন হাজার।
এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা করোনাভাইরাস (কোভিড–১৯) মহামারিতে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ভারত। দেশটিতে দিনে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা নতুন নতুন রেকর্ড গড়ছে। বেশ কয়েক দিন ধরে প্রতিদিন সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। পাশাপাশি গড়ে সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। হাসপাতালে পাওয়া যাচ্ছে না শয্যা। তীব্র শ্বাসকষ্টে ভোগা স্বজনের জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার পেতে লাইন ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে রোগীদের মৃত্যুর খবরও আসছে প্রায় প্রতিদিনই।
সবচেয়ে সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়েছে দিল্লিতে। সেখানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে শ্মশানগুলোতে দিন–রাত কাজ করেও মৃতদেহ দাহ শেষ হচ্ছে না। শ্মশানের আশপাশের পাশাপাশি পার্ক ও খোলা জায়গায় নতুন নতুন চিতামঞ্চ তৈরি করতে হচ্ছে। গত রোববারও দিল্লিতে করোনায় ৪০৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর সেখানে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ২০ হাজার।
গত মার্চের মাঝামাঝিতেও ভারতে এক দিনে শনাক্ত করোনা রোগীর সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের কাছাকাছি। এরপর দেশটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গতকাল ভারতে মোট ৩ লাখ ৬৯ হাজারের বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হয়। মৃত্যু হয় ৩ হাজার ৪০০ জনের বেশি মানুষের। এর আগে গত শুক্রবার ভারতে প্রথম এক দিনে চার লাখের বেশি মানুষের করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ে। তার আগে টানা ৯ দিন ধরে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ছিল তিন লাখের বেশি। এর সবগুলোই এক দিনে কোনো একটি দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক করোনা সংক্রমণ শনাক্তের রেকর্ড।
সংক্রমণ বৃদ্ধির পর দিল্লিতে হাসপাতালের শয্যা ও অক্সিজেনের জন্য হাহাকারের খবর আসতে থাকে। গত ২৩ এপ্রিল নয়াদিল্লির একটি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটে ২৫ জন রোগীর মৃত্যু হয়। এরপর গত শনিবার দিল্লির আরেকটি খ্যাতনামা হাসপাতালে অক্সিজেন শেষ হয়ে গেলে এক চিকিৎসকসহ মারা যান ১২ জন করোনা রোগী। এর মধ্যে রোববার রাতে কর্ণাটক রাজ্যের একটি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে ২৪ জন করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
গতকাল সোমবার বিবিসির খবরে বলা হয়, দিল্লিতে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অক্সিজেন সংকট চলতে থাকলেও অবস্থার উন্নতির কোনো লক্ষণ এখনো নেই। রোববার সারা রাতও দিল্লির বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে জরুরি অক্সিজেন সরবরাহের জন্য একের পর এক বার্তা পাঠানো হয়েছে। দিল্লির অনেক হাসপাতালই প্রতিদিনের পাওয়া অক্সিজেনের ওপর ভর করে করোনা রোগীদের চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে। সময়মতো অক্সিজেন না এলে রোগীদের প্রাণ রক্ষায় তাঁদের করার কিছু থাকছে না। ছোট হাসপাতালগুলোতে সংকট আরও গুরুতর। অক্সিজেন সংরক্ষণের ট্যাংক না থাকায় তাদের শুধু বড় সিলিন্ডারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
দিল্লির শ্রী রাম সিং হাসপাতালের চিকিৎসক গৌতম সিং জানান, তাঁদের হাসপাতালে কোভিড রোগীদের জন্য ৫০টি শয্যা এবং ১৬টি আইসিইউ রয়েছে। কিন্তু অক্সিজেন সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় রোগী ভর্তি না করে ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বিপর্যয় এড়াতে গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার অক্সিজেনের জন্য জরুরি বার্তা পাঠিয়েছেন তিনি। এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা প্রতিদিন যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি, তা একটি যুদ্ধ। প্রতিদিন আমার হাসপাতালের অর্ধেক কর্মীকে সিলিন্ডার নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে হচ্ছে। অক্সিজেনের জন্য এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় দৌড়াচ্ছেন তাঁরা। ’
প্রতিদিনই বিপুলসংখ্যক মানুষ নতুন করে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় অনেকে অবস্থা গুরুতর হলেও হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন না। ঘরে রেখে তাঁদের চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার পেতে হাসপাতালগুলোর বাইরে ভিড় করছেন স্বজনেরা। একটি সিলিন্ডার পেতে তাঁদের কখনো কখনো ১২ ঘণ্টা পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
দিল্লির হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ স্বাভাবিক করতে বারবার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, অক্সিজেনের সংকট নেই, সমস্যা হচ্ছে পরিবহনে। তারপরও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় উষ্মা প্রকাশ করেছেন দিল্লির হাইকোর্ট। শনিবার কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। আমরা কাজের কাজ দেখতে চাই। এখনই সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হবে।...দিল্লিতে মানুষ মারা যাবে আর আমরা কি চোখ বন্ধ করে রাখব?’