কংগ্রেসের ভাঙা কোমর সোজা হবে?

সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স
সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর ছেলে রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স

ভারতে চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনের ভোটযুদ্ধে বিজেপির বিরুদ্ধে ধরাশায়ী হয়েছে কংগ্রেস। এরপর থেকেই আর পথে ফিরতে পারছে না দলটি। উল্টো দলের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদে রাহুল গান্ধীর থাকা না–থাকা নিয়ে বিভ্রান্তি, এতে আরও এলোমেলো হয়ে গেছে কংগ্রেস। এমন করুণ অবস্থা থেকে কি ফিরে আসতে পারবে কংগ্রেস?

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে টানা অনেক বছর ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে ছিল কংগ্রেস। জওহরলাল নেহরুর পর কংগ্রেসের হাল ধরেছিলেন তাঁর মেয়ে ইন্দিরা গান্ধী। কংগ্রেসের ওই সময়ের প্রবীণ নেতাদের তুলনায় ইন্দিরা ছিলেন অপেক্ষাকৃত নবীন। নেহরুর মৃত্যুর পর স্বাভাবিকভাবেই নবীন ইন্দিরাকে মেনে নিতে চাননি বয়োজ্যেষ্ঠ নেতারা। আবার ইন্দিরাও চেয়েছিলেন দলে নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ফলে প্রবীণ-নবীনের সংঘাত ছিল অনিবার্য। তা হয়েও ছিল। সেই দ্বন্দ্বে বারবার ভাগ হয়েছে কংগ্রেস। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে ইন্দিরার উজ্জ্বল ভাবমূর্তির কারণেই টিকে ছিল গান্ধী পরিবারের কংগ্রেস।

তবে চলতি বছরের লোকসভা নির্বাচনে ভরাডুবির পর কংগ্রেসে গান্ধী পরিবারের একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, কংগ্রেসের অনেক নেতা-কর্মীই গান্ধী পরিবারকে দলের একমাত্র চালিকাশক্তি হিসেবে মেনে নিতে চাইছেন না। তাঁরা চাইছেন, দলে গণতন্ত্রের চর্চা। তৃণমূলের কর্মীরা চাইছেন কেন্দ্রে গুরুত্ব। আর এই মনোভাব আরও শক্তিশালী হয়েছে নির্বাচনে শোচনীয় ফলাফলের পর রাহুল গান্ধীর দলীয় সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার ঘটনায়। এর বিপরীতে আবার দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা নেমে পড়েছেন পদ-পদবি বাগানোর যুদ্ধে।

রাহুল গান্ধী। কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন তিনি। শীর্ষ পদে ফেরার সম্ভাবনাও তিনি নাকচ করে দিয়েছেন। ছবি: এএফপি

কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধীর পদত্যাগ নিয়েও নাটক কম হচ্ছে না। নিজেই পদত্যাগ করেছেন রাহুল, তা–ও এক মাস হয়ে গেল। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে শতাব্দী প্রাচীন এই দলের হাইকমান্ড নতুন সভাপতির নাম ঘোষণা করতে পারেনি। আবার রাহুলের পদত্যাগপত্র আদৌ গৃহীত হয়েছে কি না, তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়ে গেছে। দলীয় বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক বার্তায় এখনো রাহুলকেই সভাপতি অভিহিত করা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সভাপতি পদ নিয়ে এই অনিশ্চয়তা দলের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনছে না। এ কারণে কংগ্রেসের রাজনৈতিক তৎপরতা আরও স্থবির হয়ে পড়ছে। নৌকার মাঝিরই যদি ঠিক না থাকে, তবে যাত্রীদের হাল আর কী হবে?

এদিকে দলীয় সভাপতির পদ বাগাতে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে কংগ্রেসের ডাকসাইটে নেতাদের মধ্যে। অনেক দিন পর গান্ধী পরিবারের বাইরে কারও হাতে কংগ্রেসের কর্তৃত্বের ব্যাটন যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে রয়েছেন মুকুল ওয়াসনিক (৫৯), মল্লিকার্জুন খাড়গে (৭৬), সুশীলকুমার শিনডে (৭৭), শচীন পাইলট (৪১), জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া (৪৮) প্রমুখ। বলা হচ্ছে, এরই মধ্যে সভাপতি কে হবেন, তা নিয়ে দলের নবীন-প্রবীণদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। কেউ কেউ চাইছেন দলে নবীন নেতৃত্ব। আবার জ্যেষ্ঠ নেতারা দলের নেতৃত্বে দেখতে চান বয়স্ক কোনো নেতাকে।

ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রভাব দিন দিন ক্ষয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির আবির্ভাবের একটি যোগসূত্র রয়েছে। ২০১৪ সালে মোদির নেতৃত্বেই কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করেছিল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে গতবারের চেয়েও ভালো ফল করেছে বিজেপি। মূলমন্ত্র সেই মোদিই। আর মোদির মোকাবিলা না করতে পেরে কংগ্রেসের অবস্থা তথৈবচ। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে পুরো দেশে মাত্র ৪৪টি আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। এবার পেয়েছে ৫২টি। এই দুইবারের আগে আর কখনোই লোকসভায় কংগ্রেসের আসনসংখ্যা ১০০-এর নিচে নামেনি।

১৯৭১ সাল থেকে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের আসনসংখ্যা। ২০১৪ ও ২০১৯ সালের নির্বাচনেই সবচেয়ে কম আসন পেয়েছে কংগ্রেস। ছবি: সংগৃহীত

নিন্দুকেরা বলছেন, কংগ্রেসের বর্তমান করুণ পরিস্থিতি সামাল দিতে ক্যারিশমাটিক নেতা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রবীণদের চেয়ে নবীনদেরই প্রাধান্য বেশি দেওয়া উচিত। তবে কংগ্রেসের প্রবীণ নেতারা সহজে সেই কাজ করতে দেবেন বলে মনে হয় না। নির্বাচনে ভরাডুবির পর দেওয়া বিভিন্ন বার্তায় রাহুল গান্ধী দলের প্রবীণ নেতাদের বিরুদ্ধে ‘নিষ্ক্রিয়তার’ অভিযোগ এনেছেন। তাই দলীয় নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ তরুণ নেতা শচীন পাইলটের দিকে ঝুঁকছেন। তাঁদের মতে, গান্ধী পরিবারের বাইরে একমাত্র শচীনেরই সর্বভারতীয় নেতা হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।

কংগ্রেসের দলীয় সংবিধান অনুযায়ী সভাপতি নির্বাচিত হতে হবে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে। কিন্তু ১৯৬৯ সালে দলের ভাঙনের পর থেকে মাত্র তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মতে, দলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার চর্চা পুনঃস্থাপন করা জরুরি। তা না হলে দলের সাংগঠনিক ক্ষমতা জোরদার করা যাবে না।

এবারের লোকসভা নির্বাচনে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ভালোই গলা চড়িয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। কিন্তু তাঁর ধ্বনির প্রতিধ্বনি শোনা যায়নি আঞ্চলিক জ্যেষ্ঠ নেতাদের কণ্ঠে। শোনা যাচ্ছে, এ ধরনের অসহযোগিতা পেয়েই দলের সভাপতির পদ থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রাহুল। ২০১৭ সালে দলটির সভাপতি হওয়ার পর থেকেই দলের কাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন রাহুল। এ ধরনের পরিকল্পনাও দলের হাইকমান্ডের কাছে পাঠিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তা বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল দলের চিরাচরিত ব্যবস্থা। কংগ্রেসে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের সর্বোচ্চ এখতিয়ার ওয়ার্কিং কমিটির। এই কমিটির সদস্যদের গড় বয়স ৬৭ বছর। দলে পরিবর্তন ঠেকাতে এই বয়োজ্যেষ্ঠরাই বেশি তৎপর বলে ধারণা করা হয়।

কিন্তু গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে এসে কংগ্রেসের সভাপতি পদে কি টিকে থাকা যাবে? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। কারণ, সেই ইন্দিরার আমল থেকেই কংগ্রেসে গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার একটি প্রতিযোগিতা চলে আসছে। এমনকি দলের ওয়ার্কিং কমিটির অধিকাংশ সদস্যই গান্ধী পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে কেউ সভাপতি হওয়ার অর্থ হলো, এই ‘বিশ্বাসভাজন’ নেতাদের রাজনৈতিক জীবন সংকটাপন্ন। আবার পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে দলে গান্ধী পরিবারের তিনজন থাকলেও তাঁরা হয়তো থাকবেন না নীতিনির্ধারণী পদে। এই ‘প্রবল প্রভাব’ নতুন সভাপতির জন্য যে অস্বস্তির কারণ হবে, তা অনুমান করা কঠিন নয়।

১৯৭১ সাল থেকে কংগ্রেসের পাওয়া ভোটের পরিমাণ (শতাংশে)। সাম্প্রতিক নির্বাচনে এটি ২০ শতাংশের নিচে নেমেছে। ছবি: সংগৃহীত

আবার কংগ্রেসকে এখন নরেন্দ্র মোদির কৌশলের মোকাবিলা করেই টিকে থাকার রাস্তা খুঁজতে হবে। মোদির বিজেপি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় উন্মাদনার ধুয়ো তুলেছে ভারতজুড়ে। এর বিপরীতে কংগ্রেসের কোনো পাল্টা জোরালো কর্মসূচি নেই। দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জয়া হাসান বলছেন, কংগ্রেসের আদর্শিক অবস্থান নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। গান্ধী পরিবারের প্রতি শর্তহীন আনুগত্য আদর্শের সমার্থক হয়ে পড়েছে। বিজেপি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) রাজনৈতিক আদর্শ ‘ভ্রান্ত’ ও ‘উগ্র’ হলেও, তা দিয়ে তারা জনগণকে আন্দোলিত করতে পেরেছে। সেখান থেকে মানুষকে কংগ্রেসের দিকে ঝোঁকাতে হলে পাল্টা একটি জোরালো আদর্শিক অবস্থান প্রয়োজন। এটি তৈরি করতে হলে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত সাংগঠনিক ক্ষমতা সুসংহত করতে হবে। অনেক দিনের অগোছালো অবস্থা থেকে কংগ্রেসকে ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা সতীশ মিশ্র মনে করেন, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইস্যুতে কংগ্রেসের রাজনৈতিক অবস্থানও ঘোলাটে। যেমন এনআরসি, রামমন্দির, তিন তালাক ও বালাকোট হামলার মতো ইস্যুতে বিরোধী দল হিসেবে কংগ্রেস শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারেনি। একদিকে দলটি হিন্দুত্ববাদের দিকেও কিছুটা ঝুঁকে আছে, আবার সংখ্যালঘুদের পক্ষেও থাকার বুলি আওড়াচ্ছে। এভাবে মাঝামাঝি অবস্থান নিয়ে মোদির কট্টর ডানপন্থী বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয়ী হওয়া কঠিন। তাই বিজেপিবিরোধী হিসেবে আগে কংগ্রেসকে নিজের অবস্থানটি স্পষ্ট করতে হবে। ফাঁপা বুলিতে আর চিড়ে ভিজবে না।

প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ও রাহুল গান্ধী। ছবি: রয়টার্স

এবার তাই কংগ্রেসের নিজেকে শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে। বিজেপির নরেন্দ্র মোদির মোকাবিলা করতে হলে কংগ্রেসেরও একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক চরিত্র প্রয়োজন। রাহুল গান্ধী এখনো তা হতে পারেননি। সুতরাং বিকল্প নিয়ে ভাবনাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ যত দ্রুত হয়, ততই মঙ্গল। তা না হলে ভারতে ডানপন্থী রাজনীতির জয়রথ ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।