বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারে এবার ভারত ইস্যুতে প্রধান দুটি দলকে উত্তাপ ছড়াতে দেখা যায়নি। অতীতের মতো ভারতবিরোধী অনুভূতি ছড়ানোর কোনো চেষ্টা করতে দেখা যায়নি বিএনপিকে। ভারতকেও এবার বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে দেখা যাচ্ছে না। ভারতের ইংরেজি দৈনিক দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আজ শুক্রবার সকাল থেকে নির্বাচনী প্রচার বন্ধ হয়ে গেছে। আর ৪৮ ঘণ্টা পর রোববার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তবে এবারের নির্বাচনী প্রচারে বরাবরের মতো ‘ভারত ইস্যু’ দেখা যায়নি। অথচ অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে আগে ভারতকে টেনে আনার ‘বাহুল্য’ ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর মতো নয়, ভারত শুধু ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন চাওয়া ছাড়া কোনো বক্তব্য দেয়নি। কী এমন ঘটল যে ভারত কিছু বলছে না?
ভারতের একজন কূটনীতিক ঢাকায় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, এটা খুবই চমকপ্রদ যে নির্বাচনী প্রচারের সময় দুটি প্রধান দল ভারতের কথা উল্লেখ করেনি।
হিযবুত তাহ্রীর মতো একটি ইসলামী গোষ্ঠী ভারতবিরোধী কিছু বক্তব্য দেওয়া ছাড়া বিএনপি বা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা নির্বাচনী প্রচারে ভারতবিরোধী অনুভূতি নিয়ে কোনো কথা বলেননি।
জাতীয়বাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বিগত নির্বাচনগুলোতে আওয়ামী সভানেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ভারতমুখী’ বলে প্রচার চালাতেন। খালেদা জিয়া এখন দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দী রয়েছেন।
ভারতীয় ওই কূটনীতিক বলেন, ‘আমি মনে করি, তারা (বিএনপি) হয়তো বুঝতে পেরেছে ভারতকে দূরে সরিয়ে রেখে বিএনপির কোনো লাভ হয়নি।’
সাবেক কূটনীতিক ও খালেদা জিয়ার পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সাবিহ উদ্দিন আহমেদ এ ব্যাপারে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘এবার ভারত কোনো ইস্যু নয়। দিল্লির মসনদে বিজেপি নাকি কংগ্রেস বসল, সেটা নিয়ে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। একইভাবে ভারত সরকারেরও উচিত নয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি জিতল, সেটা নিয়ে ভাবা।’
আগের নির্বাচনগুলোতে বিএনপি প্রথাগতভাবে ভারত বিরোধিতায় নেতৃত্ব দিয়েছে, এতে তাদের অবস্থানের কোনো তারতম্য হয়নি, বরং ২০১৪ সালে দলটি নির্বাচনী তাপে আঙুল পুড়িয়েছে। সেবার বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার পর দিল্লি হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে পুনর্নির্বাচনে কোনো চাপ দেয়নি, উল্টো হাসিনার জয়কে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিএনপির অনেকে ওই নির্বাচন বর্জন করাকে ‘গুরুতর ভুল’ বলে মনে করেছেন।
ভারতের পক্ষে যা কাজ করেছে, তা হলো কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। শীর্ষপর্যায়ে কয়েকটি ক্ষেত্রে সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছে। গত পাঁচ বছরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ১০টি বৈঠক হয়েছে, ৬টি ভিডিও কনফারেন্স হয়েছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচবার টেলিফোনে কথা হয়েছে। দুই নেতা যৌথভাবে ১৯টি উন্নয়ন প্রকল্প নিয়েছেন। তাঁরা ৯০টির বেশি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। এর মধ্যে মহাকাশ, তথ্যপ্রযুক্তি, ইলেকট্রনিকস, সাইবার নিরাপত্তা, বেসামরিক পরমাণু শক্তির মতো নতুন নতুন ক্ষেত্র রয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বাংলাদেশে ২৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, এই প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিল নয়াদিল্লিও। বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে ১৯৭১ সালের পর প্রথমবার কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। বাংলাদেশ চীন থেকে ৮০ শতাংশ সামরিক যন্ত্রপাতি কেনে।
গত তিন বছরে ভারত বাংলাদেশে বিনিয়োগ ৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৮ বিলিয়ন ডলার করেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সাড়ে ৩১ শতাংশ বেড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ আশিকুর রহমান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, ‘আমি মনে করি, শেখ হাসিনা ভূরাজনৈতিক অভিযাত্রা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছেন এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সমান সমান অংশীদারত্ব রয়েছে।’
তবে সত্যিকারভাবে খেলা পাল্টে দিয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য ভারতের ভিসা সহজীকরণ প্রক্রিয়া। ৩ বছরে ৩ ধাপে এটা বেড়েছে। ২০১৫ সালে ৫ লাখ থেকে বেড়ে এখন তা সাড়ে ১৪ লাখ হয়েছে। ভারতীয় এক কূটনীতিক এ সম্পর্কে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ এখন সচ্ছল হয়েছে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তাই তারা কেনাকাটা করতে অথবা শুধু সপ্তাহের ছুটিতে বারে যাওয়ার জন্য কলকাতায় যায়।
নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করলেও নয়াদিল্লি এটাকে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ আখ্যা দিয়ে তার শুভকামনা বজায় রেখেছে। তবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ভারত ৩ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষককে পাঠাচ্ছে।