গত বছর করোনার ধাক্কাটা সামলাতে যখন হিমশিম খাচ্ছে বিশ্ব, ঠিক সে সময় মহামারিকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসার পরিকল্পনা করছিলেন ভারতের ধনকুবের সাইরাস পুনেওয়ালার ছেলে। তিনি আদর পুনেওয়ালা, সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে বড় টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। নিজ প্রতিষ্ঠানকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনার টিকা সরবরাহের আশ্বাস দিয়েছিলেন পুনেওয়ালা। জোগাড় করেছিলেন কোটি কোটি মার্কিন ডলার। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। এতে ভুক্তভোগী হয়েছে বাংলাদেশও।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন বলছে, করোনার টিকা উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবে আনা পুনেওয়ালার জন্য বড় সিদ্ধান্ত ছিল। কারণ, সে সময় বাজারে আসেনি কোনো টিকা। সব কটিই পরীক্ষার পর্যায়ে ছিল। সবচেয়ে আশা জাগাচ্ছিল অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা। সেটি নিয়েই সামনে এগোনোর সিদ্ধান্ত নেন পুনেওয়ালা।
সিএনএনকে পুনেওয়ালা বলেন, ‘আমরা যে ঝুঁকি নিচ্ছি, তার একটা হিসাব–নিকাশ করাই যাচ্ছিল। তবে সত্যি বলতে কি, আমি সে সময় অন্য কোনো পথ দেখিনি। আমার শুধু মনে হয়েছিল, কোনো না কোনোভাবে যদি না এগোই, তাহলে পরে পস্তাতে হবে।’
সেরামের ওপর আস্থা রেখে তাদের অর্থ দিয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক চলছিল। যুক্তরাজ্যে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা অনুমোদন পায়। ভারতে তখন মানুষের মুখে মুখে পুনেওয়ালার নাম।
অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনে যেতে ৮০ কোটি ডলার খরচা করে রাসায়নিক, কাচের ভায়াল ও কাঁচামাল কেনা হয়েছিল বলে জানান পুনেওয়ালা। এর মধ্যে ২৫ কোটি ডলার এসেছিল সেরামের নিজস্ব মূলধন থেকে। বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন থেকে মিলেছিল ৩০ কোটি ডলার। সংস্থাটির সঙ্গে চুক্তি ছিল নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে কম দামে টিকা সরবরাহ করবে সেরাম। বাকি অর্থ জোগাড় করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে অগ্রিম হিসেবে। কথা ছিল উৎপাদন শুরু হলে ধাপে ধাপে দেওয়া হবে টিকা।
গেটস ফাউন্ডেশন ও টিকা সরবরাহের বৈশ্বিক জোট গ্যাভির সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, সেরাম ইনস্টিটিউট কমবেশি ৯২টি দেশকে ২০ কোটি টিকা সরবরাহে রাজি হয়েছিল। পুনেওয়ালা বলেন, এ সবকিছুই হয়েছিল অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা অনুমোদন পাওয়ার আগে। যদি পরীক্ষাগারের ট্রায়াল শেষে টিকার ফল নেতিবাচক আসত, তাহলে সেরামকে টিকা উৎপাদন করে তা একপ্রকার ফেলে দিতে হতো।
তবে শেষ পর্যন্ত টিকার বাজারে এসেছিল। আর ২০২০ সালের মে মাসের মধ্যেই গ্যাভির সঙ্গে চুক্তির আওতায় ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তিন কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করেছিল সেরাম।
পুনেওয়ালার কর্মযজ্ঞে বড় বাধা আসে ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে। সে সময় দেশটিতে প্রতিদিন চার লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছিলেন, সংক্রমণের প্রকৃত সংখ্যা আদতে আরও বেশি। ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ২ শতাংশ টিকা পেয়েছিল। দেশটিতে সে সময় টিকার মজুতও ছিল কম। আশঙ্কা ছিল, শিগগিরই মহাসংকটে পড়তে যাচ্ছে ভারত।
এর জের ধরে ভারত থেকে করোনার টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। ফলাফল, বিদেশে টিকা সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় সেরামের। সিএনএনকে পুনেওয়ালা বলেন, ‘আমি বরাবরই দেশপ্রেমিক। যদি দেশ আমাদের প্রয়োজন মনে করে, তাদের কথামতো আমাদের কাজ করতে হবে। এ নিয়ে আমাদের অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না।’
সেরাম টিকা সরবরাহ বন্ধ করলে সংকটে পড়ে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো। আফ্রিকার রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক বলেছিলেন, টিকা রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা মহাদেশটির জন্য ‘বিপর্যয়’ ঢেকে আনতে পারে। প্রতিবেশী নেপাল থেকে কেনিয়া পর্যন্ত অনেক দেশেই সেরাম থেকে টিকা নিয়ে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছিল। তবে পরে টিকা না পেয়ে দ্বিতীয় ডোজ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।
কেন করোনার টিকার জন্য শুধু সেরামের ওপর এতটা নির্ভর করেছিল গ্যাভি—এমন প্রশ্ন তুলেছে সিএনএন। জবাবে গ্যাভির এক মুখপাত্র বলেন, ২০২১ সালের শুরুর দিকে বাজারে হাতে গোনা কয়েকটি টিকা ছিল। আর সেরামের সক্ষমতার কথা মাথায় রেখে তাদের সঙ্গে চুক্তি করা স্বাভাবিক ছিল।
তবে গ্যাভির এমন সিদ্ধান্ত ভুল বলে মনে করেছেন বার্সেলোনা ইনস্টিটিউট অব গ্লোবাল হেলথের বিশেষজ্ঞ জেফরি লাজারাস। তাঁর মতে, শুধু একটি উৎপাদনকারীর ওপর নির্ভর করা আদৌ কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না।
টিকা পেতে সেরামের সঙ্গে চুক্তি করেছিল বাংলাদেশও। বাংলাদেশের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সেরামের টিকার জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দেয় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে। এরপর টিকার প্রথম চালান আসে ২৫ জানুয়ারি। প্রথম চালানে ৫০ লাখ টিকা এসেছিল। বলা হয়েছিল, এরপর প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে ছয় মাসে ৩ কোটি টিকা আসবে। পরে ফেব্রুয়ারি মাসে সেরাম ২০ লাখ টিকা পাঠিয়েছিল। মার্চ ও এপ্রিল মাসে কোনো টিকা পাঠায়নি।
চুক্তি অনুযায়ী সেরামের টিকা সরবরাহ না করার জেরে বাংলাদেশে প্রথম ডোজ পাওয়া ১৩ লাখের বেশি মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাওয়ার অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। পরে অবশ্য ভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহ করে তাঁদের টিকা দেওয়া হয়।
ভারতের টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা সেরামের সরবরাহ বন্ধের পেছনে একটি বড় কারণ হলেও পুনেওয়ালাকে ছাড় দিতে রাজি নন তাঁর সমালোচকেরা। তাঁরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে সেরাম যে পরিমাণ টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা তারা রাখতে পারেনি। এ ছাড়া টিকা উৎপাদনের জন্য যে অর্থ জোগাড় করা হয়েছিল, এর খরচা নিয়েও পুনেওয়ালা স্বচ্ছতা দেখাতে পারেননি।
ভারতের স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্ট নজরদারি প্রতিষ্ঠান অল ইন্ডিয়া ড্রাগ অ্যাকশন নেটওয়ার্কের উপসমন্বয়ক মালিনী আইসোলা সিএনএনকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন উৎস থেকে জোগাড় করা অর্থ কোথায় যাচ্ছে, তা জানানো নিয়ে তেমন দায়বদ্ধতা রাখেনি সেরাম।
এদিকে গত বছরের জুনে সেরাম জানিয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর জন্য ১০০ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদন করবে। বছরের শেষ সময়ের মধ্যে ৪০ কোটি ডোজ প্রস্তুত রাখা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তবে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে দেখা যায়, মাত্র ৭ কোটি ডোজ টিকা মজুত করতে পেরেছে সেরাম। এ নিয়ে সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর টিকার কম উৎপাদন নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি সেরামও।
কেন সরবরাহের সক্ষমতার তুলনায় বেশি টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেরাম—সিএনএনের এমন প্রশ্নের জবাবে পুনেওয়ালা বলেন, ‘আমরা সব সময় প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করেছি।’
সেরামের টিকা সরবরাহ বন্ধ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনামও হয়, তবে নেতিবাচকভাবে। এর মধ্যেই আবার পুনেতে সেরামের টিকা উৎপাদন কারখানায় আগুন লাগে। পুনেওয়ালা বলেছিলেন, ওই অগ্নিকাণ্ড টিকার উৎপাদনে কোনো প্রভাব ফেলেনি। পরে এসে আবার ভিন্ন সুর তোলেন তিনি। জানান, আগুনে টিকার উৎপাদনব্যবস্থায় বড় ক্ষতি হয়েছে।
কথা উঠেছে সেরামের মুনাফা করা নিয়ে। মালিনী আইসোলা বলেন, অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, তারা মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো থেকে কোনো মুনাফা করবে না। তবে সেরামের জন্য বিষয়টি হয়তো একই নয়।
টিকা বিক্রি করে সেরাম কত মুনাফা করেছে, তা অবশ্য প্রতিষ্ঠানটি জানায়নি। তবে পুনেওয়ালা বলেন, টিকা বিক্রি করে কোনো প্রতিষ্ঠান লাভ করবে না—এমনটি ভাবা অযৌক্তিক।