ভোট শুরুর তিন দিন আগে প্রকাশিত বিজেপির নির্বাচনী ইশতেহারে শাসক দলের নেতারা যখন ‘লাভ জিহাদ’-এর হাজতবাসের মেয়াদ দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১০ বছর ও জরিমানার অঙ্ক ১৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা করার প্রতিশ্রুতি বড় করে তুলে ধরেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না উত্তর প্রদেশে বিজেপির অবস্থান সত্যিই নড়বড়ে। নড়বড়ে খুঁটি পোক্ত করতে ধর্মীয় মেরুকরণের মন্ত্র এই শেষবেলাতেও তাঁদের প্রধান সাহারা।
দলের এই টলমলে হাল যে শুধু শেষবেলায় অনুভূত হয়, তা নয়। পক্ষকাল আগে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও রাজ্যের জাট নেতা প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং যখন নিয়ম করে রাষ্ট্রীয় লোকদল নেতা (আরএলডি) জয়ন্ত চৌধুরীর মানভঞ্জনের চেষ্টা করছিলেন, সমাজবাদী পার্টির (এসপি) নেতা অখিলেশের খপ্পর থেকে বের করতে নানাবিধ টোপ দিচ্ছিলেন, তখনো সেটা ছিল প্রকারান্তরে নিজেদের দুর্বলতারই প্রকাশ। হয়তো অসহায়তারও। সত্যি বলতে কি, গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী এই বিস্তীর্ণ পশ্চিমাঞ্চল যে বিজেপির ‘ওয়াটারলু’ হতে পারে, ছয় মাস ধরে সেটাই ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তর প্রদেশের মূল আলোচ্য হয়ে জেগে রয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার প্রথম দফার ভোট তাই এত গুরুত্বপূর্ণ।
সাত দফা নির্বাচনে প্রথম পর্বের ভোট ৫৮ আসনে, পাঁচ বছর আগে বিজেপি যেখানে কাউকে আঁচড় পর্যন্ত কাটতে দেয়নি। সেবার এই অঞ্চলে তারা ৫৩টি আসন জিতেছিল। পরের পর্ব ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভোট ৫৫ কেন্দ্রে, যেখানে বিজেপি জিতেছিল ৩৮ আসন। দুয়ে মিলে ১১৩ আসনের মধ্যে ৯১টি জেতার পর বিজেপিকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ৪০৩ বিধানসভায় তারা পেয়েছিল ৩১২। সহযোগীরা মিলে জোটের সংখ্যা পৌঁছেছিল ৩২৫। অথচ এবার রাজ্যের এই জাট ও ব্রজভূমিই তাদের বলিরেখা গভীর করে তুলেছে।
কোভিড মোকাবিলায় ব্যর্থতা, বেহাল অর্থনীতি, বেকারত্ব, প্রশাসনের বাড়াবাড়ি রকমের ‘ঠাকুরবাদ’জনিত অসন্তোষ তো আছেই, শাসকের বলিরেখা গভীর করে তোলার জন্য প্রধানত দায়ী কেন্দ্রীয় তিন কৃষি আইন। উত্তর ভারতের কৃষিপ্রধান অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে থাকা মানুষদের যা আন্দোলনে টেনে আনে। বিপদ কতখানি, সেই উপলব্ধি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির যখন হলো, যে সময় তিন আইন বাতিল করলেন, ততক্ষণে ধর্ম ও জাত ভুলে কৃষক সমাজ এককাট্টা। ২০১৩ সালের মুজাফফরনগরের রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা গোটা উত্তর প্রদেশে তো বটেই, বিশেষ করে জাটভূমিতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে পাঁচিল তুলে দিয়েছিল, কৃষক আন্দোলন তা ভেঙে দেয়। এই বিভাজন, আরও স্পষ্ট করে বললে জাট ও মুসলমানের সংঘাতের ফসল, ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা এবং ২০১৭ সালের বিধানসভা ভোটে বিজেপিকে লাভবান করেছিল। কৃষক আন্দোলন ধর্ম ও জাতের সেই ভাগাভাগি কতটা মিলিয়ে দিতে পারল, কতটা এক জোট হয়ে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ স্লোগানকে সার্থক করে তুলতে পারল, তার প্রতিফলনের ওপর ঝুলে থাকছে উত্তর প্রদেশে বিজেপির ভাগ্য। এবারের ভোট সেই কারণে তাই ‘কমণ্ডলু বনাম মণ্ডল’ রাজনীতির দ্বৈরথে পর্যবসিত।
ভাগ্য যাতে বিরূপ না হয়, সে জন্য বিজেপি চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি। জাতপাতের সমীকরণ ভুলে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, কায়স্থ, অনগ্রসর ও দলিত সমর্থনের ধারাবাহিকতা এবারও যাতে অব্যাহত থাকে, সে জন্য মোদি-যোগী-শাহ প্রাণপাত করছেন। কিন্তু প্রথম দুই পর্বের ভোট যেখানে, সেখানকার রাজনীতির রাশ সবচেয়ে বেশি জাট ও মুসলমানের হাতে। ব্রজভূমির হাল সব সময় থেকেছে অনগ্রসরদের মধ্যে অগ্রসর যাদবদের হাতে। আগেরবারের মতো এবারও তাদের হিন্দুত্বের জোয়ারে ভাসানোর জন্য বিজেপি যা যা করার করেছে। অযোধ্যার রামমন্দির থেকে শুরু করে লাভ জিহাদের শাস্তি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি, ধর্ম সংসদ থেকে উদ্গারিত হিংসা ও দ্বেষ, গোরক্ষা আন্দোলনের বিস্তার এবং আইনশৃঙ্খলাজনিত সমস্যা সমাধানে যোগী প্রশাসনের কঠোর মানসিকতার প্রচারে বিজেপি খামতি রাখেনি। কিন্তু এসব প্রচার ছাপিয়ে শেষবেলায় বিজেপির চিন্তা বাড়িয়েছে তফসিলভুক্ত অনগ্রসরদের ক্ষোভ ও অসন্তোষ। প্রভাবশালী অন্য অনগ্রসর নেতাদের (ওবিসি) দলত্যাগ এবং সদলে অখিলেশ-জয়ন্ত শিবিরে আশ্রয় লাভ বিজেপির চেনা ছক অনেকটাই বানচাল করে দিয়েছে। ক্ষতি কতখানি, প্রথম দুই পর্বের ভোট তার ইঙ্গিতবাহী হয়ে থাকবে।
ভোট-ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক যদি স্রেফ পাটিগণিত হতো, তা হলে চোখ বুজে বলে দেওয়া যেত জাটভূমি হতে চলেছে বিজেপির বধ্যভূমি। কথাটা এতখানি নিশ্চিত হয়ে বলা যাচ্ছে না তিনটি কারণে। প্রথমত, জাট মন গলাতে বিজেপি চেষ্টায় ত্রুটি রাখেনি।
দলের জাট নেতাদের সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছে। কৌশল ঠিক করেছে। নানাভাবে বিক্ষুব্ধ মনে প্রলেপ দিতে চেয়েছে। মোগলদের বিরুদ্ধে জাটদের লড়াইয়ের ইতিহাস মনে করিয়ে দিয়েছে। এমনকি এই ভয়ও দেখিয়েছে, অখিলেশ মুখ্যমন্ত্রী হলে ‘হিন্দু জাট’ জয়ন্তকে ছাপিয়ে মাথাচাড়া দেবে সমাজবাদী ‘বাহুবলি’ আজম খানের বাহিনী।
অর্থাৎ অখিলেশের রাজত্বে জাটেরা হয়ে যাবে এলেবেলে, ছড়ি ঘোরাবে মুসলমান। এই প্রচারে জাট-মনের কিছুটা দ্রব হয়ে কৃষকসত্তার বাইরে বেরিয়ে ‘হিন্দু’ হয়ে আবার বিজেপির দিকে ঝুঁকলে নির্বাচনী ফল ততটা খারাপ না-ও হতে পারে। বিজেপির বড় আশা ওখানেই। ওই আনুগত্যে।
দ্বিতীয় কারণ ঘূর্ণমান বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) নেত্রী মায়াবতীকে কেন্দ্র করে। আসন পাক বা না পাক, আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনে বিএসপি ১৯ শতাংশের কম ভোট পায়নি। দলিতদের কাছে মায়াবতী চিরকালীন মুকুটহীন রানি। সেই মায়াবতী এবার অদ্ভুতভাবে নিষ্প্রভ। প্রথম পর্বের ভোটে তাঁর চেয়ে কম প্রচার ও পরিশ্রম আর কেউ করেননি। মায়াবতীর এই আপাত নিস্পৃহতার অর্থ কী, নানা জনে নানাভাবে তার ব্যাখ্যা করছেন। কিন্তু কেউ নিশ্চিত নয়, তাঁর চিরায়ত দলিত সমর্থনে ভাটার টান দেখা দেবে কি না। তা ছাড়া বিএসপির ভোট শতাংশ কম হলে দলিত সমর্থন কোন দিকে গড়াবে, সেটাও বড় প্রশ্ন। হিন্দু হয়ে বিজেপির ঝুলিতে, নাকি বর্ণহিন্দুর নিষ্পেষণে ক্ষুব্ধ অনগ্রসর বিক্ষোভের রেশ নিয়ে ইভিএমের বিরোধী বোতামে। বিএসপির জন্ম থেকে দলিত মন (বিশেষ করে জাট, দলিত) কাঁসিরাম-মায়াবতীর ইশারার বাইরে কিন্তু কখনো বেরোয়নি। এবার তাদের মন এখনো অজানা।
তৃতীয় প্রশ্ন, মুসলমান মন ঘিরে। কোনো সন্দেহ নেই, অখিলেশের যাদব-মুসলমান জুটির সঙ্গে জয়ন্ত চৌধুরীর জাট সমর্থন অটুট থাকলে বাকি সবাই ভোকাট্টা। সেই লাভের গুড়ে ভাগ বসাতে জাটভূমিতে মুসলমান মন জিততে এই প্রথম নড়েচড়ে বসেছেন হায়দরাবাদের অল ইন্ডিয়া মজলিস ই ইত্তেহাদুল মুসলিমিন নেতা আসাদুল্লাহ ওয়াইসি। একাধিকবার তিনি এই অঞ্চল সফর করেছেন। প্রচারে সাড়াও পেয়েছেন বেশ। এতে উৎসাহিত বিজেপি। মোদি-যোগী-শাহ তাঁদের প্রচারে অখিলেশের দলের মুসলমান নেতাদের বিরুদ্ধে যতখানি সরব, আশ্চর্যজনকভাবে ততটাই নীরব ওয়াইসিকে নিয়ে। বরং বিজেপি যে ওয়াইসির নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন (কদিন আগে উত্তর প্রদেশে তাঁর গাড়িতে গুলি ছোড়া হয়) তা বুঝিয়ে তাঁকে ‘জেড’ ক্যাটাগরি নিরাপত্তা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পীড়াপীড়ি করেই চলেছেন। ওয়াইসির দল মুসলমান ভোটে ভাগ বসালে বিজেপির হাসিই কান ছোঁবে।
পশ্চিম-উত্তর প্রদেশের অর্থনীতি প্রধানত আখ (গন্না) চাষ ও চিনিকলকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়। অর্থনীতির মূল চাবি জাটদের হাতে। ধর্মীয় মেরুকরণের আলোয় এবারও তাই বিজেপি জাটভূমির লড়াইকে ‘গন্না বনাম জিন্না’ করে তুলতে মরিয়া। সফল হলে পোয়াবারো। না হলে পিছলে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। হারানোর ভয় যে শুধু তাদের।