১৯৯২ সালে ভাঙা হয়েছিল বাবরি মসজিদ। তবে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির ইস্যুর জন্ম ওই সময়ে নয়। ভারত ভাগের পরপরই এই অযোধ্যা বিতর্কের জন্ম। ১৯৯২ সালে এই বিতর্ক বিরোধে পরিণত হয়, ঘটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মসজিদ-মন্দির নিয়ে এই বিতর্ক মেটাতে সম্প্রতি ভারতের সর্বোচ্চ আদালত মধ্যস্থতার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু মধ্যস্থতা করে এই বিতর্ক কি মেটানো সম্ভব?
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত শুক্রবার মধ্যস্থতা করার জন্য তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। আদালত বলছেন, অযোধ্য বিতর্ক নিয়ে অন্তত একবারের জন্য হলেও মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এই মধ্যস্থতার স্থান, কাল, পাত্রও নির্ধারণ করে দিয়েছেন আদালত। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার আলাপ-আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদে। শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে ক্ষণ গণনা। এক সপ্তাহের মধ্যে মধ্যস্থতার কাজ শুরু করতে হবে। মধ্যস্থতার স্থান ও মধ্যস্থতাকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে উত্তর প্রদেশের রাজ্য সরকার।
আদালতের নির্দেশে আরও বলা হয়েছে, এই মধ্যস্থতার সব কার্যক্রমে কঠোর গোপনীয়তা বজায় থাকবে। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়ার ক্ষতি যাতে না হয়, সে জন্য আলোচনার কোনো অংশ আগ বাড়িয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। মধ্যস্থতা শুরুর পর চার সপ্তাহের মধ্যে এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে হবে এবং পুরো আলোচনা শেষ করতে হবে আগামী আট সপ্তাহের মধ্যে।
সুপ্রিম কোর্টের গঠন করা মধ্যস্থতাকারীদের কমিটি নিয়েও ইতিমধ্যে শোরগোল উঠেছে। তিনজনের কমিটিতে আছেন—সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারক ফকির মোহাম্মদ ইব্রাহিম কলিফুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শ্রীরাম পাঁচু ও আধ্যাত্মিক গুরু শ্রীশ্রী রবি শংকর। মজার বিষয় হলো, এই তিনজনই তামিলনাড়ু রাজ্যের। ডেকান হেরাল্ড বলছে, অযোধ্যা বিতর্ক নিয়ে পুরো ভারতে যতই দাঙ্গা-বিক্ষোভ হোক না কেন, তামিলনাড়ুতে কখনোই এর কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ বাবরি মসজিদ বা রামমন্দির—এসব নিয়ে তামিলদের কোনো মাথাব্যথাই নেই। মধ্যস্থতাকারীদের কমিটির প্রধান হলেন ফকির মোহাম্মদ ইব্রাহিম কলিফুল্লাহ। আদালত বলে দিয়েছেন, প্রয়োজনে মধ্যস্থতাকারীর সংখ্যা আরও বাড়াতে পারে এই কমিটি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, আদালতের আদেশে এটি স্পষ্ট যে, অযোধ্যা বিতর্ককে স্রেফ আইনের চোখে এখন আর দেখা হচ্ছে না। যে ২ দশমিক ৭৭ একর জমি নিয়ে দশকের পর দশক ধরে বিতর্ক চলছে, সেটিকে দেখা হচ্ছে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। আদালত চাচ্ছেন, এর সমাধান করতে গিয়ে যেন কোনো পক্ষ অসন্তুষ্ট না হয়। কিন্তু ইতিহাস বলছে, এভাবে সমাধান পাওয়া প্রায় অসম্ভব।
প্রশ্ন উঠেছে, যে মধ্যস্থতাকারীদের নির্বাচন করা হয়েছে, তাঁরা কি যোগ্য? তাঁরা কি পারবেন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দিরের নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মেটাতে?
ফকির মোহাম্মদ ইব্রাহিম কলিফুল্লাহ: মধ্যস্থতাকারী দলের নেতা তিনি। পেশাগত দিক থেকে কলিফুল্লাহ ছিলেন আইনজীবী। ২০০০ সালে তিনি মাদ্রাজ হাইকোর্টের বিচারক নিযুক্ত হোন। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ভারত–নিয়ন্ত্রিত জম্মু-কাশ্মীরের হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি ছিলেন।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, কলিফুল্লাহর বাবাও ছিলেন বিচারক। তামিলনাড়ুর শিবাগঙ্গা জেলায় কলিফুল্লাহর জন্ম। বলা হয়ে থাকে, জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ কাশ্মীরিদের মনে ন্যায়বিচার পাওয়ার আস্থা জাগিয়েছিলেন তিনি। কর্মজীবনে বেশ কয়েকটি আলোচিত মামলার রায় দিয়েছিলেন কলিফুল্লাহ। অবসরে যাওয়ার এক দিন আগে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিসিআই) পরিকাঠামো–সংক্রান্ত মামলায় যুগান্তকারী রায় দিয়েছিলেন তিনি। তাতে পুরো বিসিসিআইয়ের কাঠামো ও কর্মপ্রক্রিয়াই বদলাতে হয়েছিল!
২০১৫ সালে কলিফুল্লাহর দেওয়া এক রায়ে পিছু হটতে হয়েছিল তামিলনাড়ুর রাজ্য সরকারকে। সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া ওই আদেশে বলা হয়েছিল, রাজীব গান্ধী হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের মুক্তি দেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই রাজ্য সরকারের। এ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত দেবে শুধুই কেন্দ্রীয় সরকার। এ ছাড়া ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈদিক জ্যোতিষবিদ্যা–বিষয়ক কোর্স চালুর বিষয়েও নির্দেশনা দিয়েছিলেন কলিফুল্লাহ।
অযোধ্যা বিতর্কের মধ্যস্থতাকারী কমিটির প্রধান হিসেবে নতুন ভূমিকায় দেখা যাবে কলিফুল্লাহকে। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সম্ভাবনাও কম।
শ্রীরাম পাঁচু: তিনি একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। আদালতের বিচারক হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছিলেন শ্রীরাম পাঁচু। ভারতে মধ্যস্থতা করার সংস্কৃতি চালুর পুরোধা ব্যক্তি তিনি। ১৯৯০ সালের পর থেকে বিতর্কের অবসানে মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া চালুর পথিকৃৎ এই শ্রীরাম পাঁচু।
টাইমস অব ইন্ডিয়া বলছে, মুম্বাইয়ের এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক পাস করেন পাঁচু। ১৯৭৬ সালে আইনের ওপর ডিগ্রি নিয়ে তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর মর্যাদা পান এবং ভারতের অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়ান মিডিয়েটরস নামক সংস্থার তিনি সহসভাপতি। পাঁচ শরও বেশি মধ্যস্থতাকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পাঁচু।
এই ট্র্যাক রেকর্ডের ভিত্তিতে বলাই যায় যে, অযোধ্যা বিতর্ক অবসানে সঠিক লোককেই বেছে নিয়েছেন আদালত। এর আগে আসাম ও নাগাল্যান্ড রাজ্যের সীমা–সংক্রান্ত বিরোধ মধ্যস্থতা করে মিটিয়েছিলেন পাঁচু। তবে এবারের কাজ যে আরও কঠিন, তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারও। পাঁচু জানিয়েছেন, অযোধ্যা বিতর্কের সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন তিনি।
শ্রীশ্রী রবি শংকর: এই আধ্যাত্মিক গুরুকে নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। নিন্দুকেরা বলছেন, অযোধ্যা বিতর্ক নিয়ে এর আগেও মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন শ্রীশ্রী রবি শংকর। কিন্তু সে ক্ষেত্রে কার্যত একটি পক্ষকে সমর্থন দিয়েছিলেন তিনি।
ইকোনমিক টাইমস জানাচ্ছে, আর্ট অব লিভিং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীশ্রী রবি শংকর। তিনি সব সময়ই বলে এসেছেন যে, অযোধ্যা বিতর্কের সমাধান আদালতে সম্ভব নয়। তাঁর মতে, এই সমস্যার সমাধান করতে হবে আদালতের বাইরে, মধ্যস্থতার মাধ্যমে।
স্ক্রল ডট ইন বলছে, মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় শ্রীশ্রী রবি শংকরকে বেছে নেওয়াতেই বিতর্কের সূত্রপাত হচ্ছে। কারণ এর আগে এক সাক্ষাৎকারে রবি শংকর বলেছিলেন যে, অযোধ্যা বিতর্কের সমাধান করার জন্য মুসলিমদের জমির দাবি ছেড়ে দেওয়া উচিত। সেদিক থেকে স্পষ্টতই রবি শংকর একটি পক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল। এমন ব্যক্তি কীভাবে সব পক্ষের জন্য সন্তোষজনক সমাধানের উপায় খুঁজে বের করবেন—তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।
গত বছর ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শ্রীশ্রী রবি শংকর বলেছিলেন, মুসলিমদের বিশ্বাসের জায়গা অযোধ্যা নয়। তাই মুসলিমদের এই জমির দাবি ছেড়ে দেওয়া উচিত। তাঁর দেওয়া সমাধানের সূত্রমতে, হিন্দুদের এক একর জমি ছেড়ে দেবে মুসলমানরা। এর বদলে হিন্দুরা কাছাকাছি কোনো স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর জমি ছেড়ে দেবে। নতুন নির্মিত মন্দিরের ক্ষেত্রে স্বীকার করে নেওয়া হবে যে, হিন্দু ও মুসলমানদের যৌথ সহযোগিতায় তা নির্মাণ করা হয়েছে। এবং এভাবেই অযোধ্যা বিতর্কের সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন রবি শংকর। এর অন্যথা হলে ভারতে গৃহযুদ্ধও লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাঁর।
অবশ্য নিন্দুকেরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। তখন হিন্দু মৌলবাদীরা ভারতের বিভিন্ন স্থানে মসজিদের জায়গায় মন্দির নির্মাণের দাবি তুলতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক সংঘাত আরও বাড়তে পারে।
মধ্যস্থতায় মিটবে অযোধ্যা বিতর্ক?
সংশয়বাদীদের জিজ্ঞাসা, আদৌ কি এই মধ্যস্থতায় কোনো সমাধান হবে? কেউ কেউ আশাবাদী হচ্ছেন বটে। তাঁদের কথা, আদালতে আইনের দৃষ্টিতে ফয়সালা হওয়ার আগে একবার মধ্যস্থতার চেষ্টা করা যেতেই পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অন্য পক্ষের বক্তব্য শোনা ও যুক্তিযুক্তভাবে তা মেনে নেওয়ার বাস্তবতা কি ভারতে এখন আছে?
ইতিহাসের দিকে তাকালে অবশ্য মধ্যস্থতার বিষয়ে সংশয়বাদী হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কারণ এর আগেও অযোধ্যা বিতর্ক নিয়ে কয়েক দফা মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোনোটিতেই সফলতা পাওয়া যায়নি। ২০১০ সালের আগস্ট মাসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্ণৌ বেঞ্চ মধ্যস্থতার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে বের হওয়া সমাধান মেনে নেয়নি হিন্দুরা। ২০১৭ সালের মার্চে ভারতের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহার মধ্যস্থতার প্রস্তাব তুলেছিলেন। কিন্তু তা কেবল প্রস্তাবেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং একসময় পরিত্যক্ত হয়। ১৯৯২ সালের আগেও এ নিয়ে মধ্যস্থতার ঢের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার পর সব মধ্যস্থতাই ভেস্তে যায়।
এবার আদালত বলে দিয়েছেন, মধ্যস্থতার মাধ্যমে যে সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে, তাতে বিবদমান সব পক্ষের সম্মতি থাকতে হবে। কিন্তু সব পক্ষকে পোষ মানিয়ে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির ইস্যুতে সমাধান খুঁজে বের করা অত্যন্ত দুষ্কর বলেই মনে হয়। সমালোচকেরা বলছেন, মধ্যস্থতার পথে এগিয়ে বিতর্ক মেটানোর পুরো কাজটিই স্থবির হয়ে যেতে পারে। তখন উল্টো এ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এখন বিজেপির নেতৃত্বাধীন। খুব স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার রাজনৈতিক ফসল ঘরে তোলার চেষ্টা করবে নরেন্দ্র মোদির দল। আজকেই ঘোষণা হয়ে গেছে আসন্ন লোকসভার নির্বাচনের দিনক্ষণ। সুতরাং ভোটের আগে যত দিন এই অযোধ্যা বিতর্ক জিইয়ে রাখা যায় এবং রামমন্দির ইস্যুকে প্রচারের আলোয় রাখা যায়, মোদির দলের ততই মঙ্গল।
কথা হলো—অন্যান্যবারের মতো এবারও যদি মধ্যস্থতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়, তখন সুপ্রিম কোর্ট কি করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর সহসা জানার কোনো উপায় নেই। হয়তো অতীতের মতো আদালতের এক বেঞ্চ থেকে আরেক বেঞ্চে ঘুরতে থাকাই অযোধ্যা বিতর্কের ভবিতব্য!