কয়েক মাস ধরেই রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলছিলেন ইয়েভগেনি প্রিগোশিন। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু এবং ইউক্রেনের রণক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া ভ্যালেরি গেরাসিমোভের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অদক্ষতা ও ভুলভ্রান্তির অভিযোগ তুলে সোচ্চার হয়েছিলেন তিনি।
একটি ভিডিওতে যুদ্ধক্ষেত্রে ভাগনার গ্রুপের যোদ্ধা নিহত হওয়ার জন্য মস্কোকে দায়ী করেছেন প্রিগোশিন। ওই ভিডিওতে তাঁর পেছনে নিহত সেনাদের সারিবদ্ধ লাশ দেখা যায়। আবার একটি চিঠিতে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুকে নিজে এসে রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র দেখে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ জানান। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় বাখমুত শহরে ইউক্রেন বাহিনীকে মোকাবিলা করছিলেন ভাগনার গ্রুপের যোদ্ধারা, সেখানে শোইগুকে আসতে বলেছিলেন তিনি।
প্রিগোশিন ও শোইগুর মধ্যকার বিরোধ বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। তবে পুতিনের সরকার পরিচালনার ব্যবস্থা পশ্চিমা ধাঁচের নয়, অনেকটা অটোমান শাসকদের মতো। দুই দশকের বেশি সময় ধরে পুতিন রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সমস্যার সমাধানে প্রধান সিদ্ধান্তদাতার ভূমিকায় আছেন।
এটা বিভাজন ও শাসন করার পুরোনো কৌশল। প্রিগোশিন এত দিন নিজেকে পুতিনের অনুগত হিসেবে প্রমাণ করেছেন। অনলাইন তৎপরতার মাধ্যমে ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সংশ্লিষ্ট একজন বিশ্লেষকের মতে, প্রিগোশিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুর বিরুদ্ধে যে চূড়ান্ত অবস্থানের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, তার পেছনে রাশিয়ার সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তির এত দিনের প্রশ্রয়ের ভূমিকা রয়েছে।
শনিবারের নাটকীয় ঘটনাবলি অবশ্য ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। প্রিগোশিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শোইগুকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার পুরো জেনারেল স্টাফে পরিবর্তন চেয়েছেন। শনিবার রাতে অবশ্য তিনি রক্তপাত এড়াতে বাহিনীর যোদ্ধাদের মস্কোর দিকে যাত্রা বাদ দিয়ে ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বলেন।
এর আগে ভাগনার গ্রুপের সাঁজোয়া যানের বহর ইউক্রেনের দখলকৃত পূর্বাঞ্চল থেকে রাশিয়ার মধ্যে ঢোকে। এ সময় তাদের কোনো বাধার মুখে পড়তে হয়নি। ভাগনারের যোদ্ধারা রোস্তভ-অন-দন শহরে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর দক্ষিণাঞ্চলীয় কমান্ড দপ্তর নিয়ন্ত্রণে নেন। এই দপ্তর ইউক্রেনে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় রয়েছে।
আকস্মিক ভাগনার যোদ্ধাদের এই তৎপরতায় আতঙ্কিত রুশ জেনারেলরা প্রিগোশিনকে তাঁর এই সশস্ত্র বিদ্রোহ থামাতে বলেন। এদিকে মস্কোর রাস্তায় সাঁজোয়া যান টহল দিতে শুরু করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য সরকারি দপ্তরকে এই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের আক্রমণ থেকে রক্ষায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেড তৈরি করে। মস্কো অভিমুখী মহাসড়কের জায়গায় জায়গায় কেটে যান চলাচলের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়।
এই চিত্র ১৯৯১ সালের গ্রীষ্মের ব্যর্থ সামরিক তৎপরতাকে মনে করিয়ে দেয়। সে সময় এটা করেছিলেন রুশ গোয়েন্দা সংস্থার কট্টরপন্থীরা। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে রাস্তায় নেমেছিলেন তাঁরা। তবে তাতে কাজ হয়নি। এর কয়েক মাস পরই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে।
সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কি না, সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। প্রিগোশিন শান্তির পক্ষের কেউ নন। তাঁর লক্ষ্য রাশিয়ার পক্ষে ইউক্রেনে আরও নৃশংস অভিযান পরিচালনা।
প্রিগোশিন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। তা ছাড়া গত বছর ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন শহর এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় খারকিভ থেকে রুশ সেনাদের প্রত্যাহারের ঘটনায় অসন্তোষ রয়েছে তাঁর।
শনিবারের বিস্ময়কর নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যা-ই হোক না কেন, এর মধ্য দিয়ে পুতিনকে তাঁর শাসনামলের (২০০০ সাল থেকে) অন্য যে কোনো সময় থেকে দুর্বল মনে হয়েছে। প্রিগোশিনের বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর শনিবার সকালে টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন পুতিন। তিনি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ এবং মস্কোয় সন্ত্রাসী সরকার আনতে মাঠে নামার অভিযোগ তোলেন।
অল্প সময়ের মধ্যেই এই বিদ্রোহের সমাপ্তি ঘটলেও এর জের থাকবে বেশ কয়েক মাস ধরে। এর জের ধরে রাশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেওয়ার পাশাপাশি পুতিনের নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
এই বিদ্রোহ ইউক্রেনের জন্য সম্ভাবনা তৈরি করেছে। ভাগনারের যোদ্ধারা রাশিয়ার দখলকৃত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক এলাকায় মোতায়েন ছিলেন। গত জুনে ইউক্রেন বাহিনী পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাংক নিয়ে পাল্টা হামলা শুরু করে। তাদের লক্ষ্য, পূর্ব দনবাসের দখলকৃত অঞ্চলের সঙ্গে ক্রিমিয়া এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া প্রদেশের যোগাযোগের পথ পুনরুদ্ধার করা।
এই লড়াইয়ে ইউক্রেন বাহিনীর অগ্রগতি প্রত্যাশিত নয়। রুশ বাহিনী পথে পথে বোমা পুঁতে রেখেছে, ট্যাংক আটকানোর পরিখা খনন করেছে এবং ইউক্রেন বাহিনীর অগ্রগতি রুখতে তার বিমান বাহিনী ও কামান ব্যবহার করছে। বর্তমানে দুই বাহিনীর মধ্যে ৬০০ মাইল এলাকায় লড়াই চলছে। এই যুদ্ধে কোনো পক্ষই কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না পাওয়ায় অচিরেই এর সমাধান হচ্ছে না বলে মনে করেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে।
সেখানে প্রিগোশিনের নতুন অবস্থান ওই হিসাবে পরিবর্তন আনতে পারে। তবে রাশিয়ার সেনাবাহিনীকে আমলে না নেওয়াটা বোকামি হবে। শেষ বিচারে বলা যায়, এর মধ্য দিয়ে চলতি গ্রীষ্মে ইউক্রেনের ভালো অগ্রগতি পাওয়ার সম্ভাবনা অনেকটা বেড়েছে। যদি রাশিয়ার সম্মুখসারির যোদ্ধাদের মনোবল ভেঙে যায়, সেনারা আর যুদ্ধ করতে না চান, তাহলে ইউক্রেনের জন্য সামনে এগিয়ে যাওয়াটা সহজ হবে।
পুরো ইউক্রেন দখল এবং সেটাকে রাশিয়ার সঙ্গে অঙ্গীভূত করার যে স্বপ্ন পুতিন দেখেছিলেন, তা আর পূরণ হচ্ছে না। তা একজন স্বৈরশাসকের খেয়ালিপনায় রূপ নিতে যাচ্ছে।