ভারত–কানাডার মধ্যকার কূটনৈতিক বিরোধ নিয়ে বিশ্বনেতারা উদ্বিগ্ন। এ বিরোধ যাতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্যান্য ক্ষেত্রে ছড়িয়ে না পড়ে, নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিতে পশ্চিমা মন্ত্রী-কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কাজ করবেন।
যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা শক্তিগুলো এখন যা চায়, তা হলো অটোয়া-নয়াদিল্লির মধ্যে চলমান বিরোধের জেরে যেন ভারতের সঙ্গে তাদের বিভক্তি বা দূরত্ব তৈরি না হয়।
কেননা, ভূরাজনৈতিক দাবার বোর্ডে ভারত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ভারত শুধু একটি ক্রমবর্ধমান শক্তিই নয়, তারা বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। তারা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। তা ছাড়া পশ্চিমারা ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য শক্তিশালী প্রতিরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে বিবেচনা করে আসছে।
বিষয়টি সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনেও স্পষ্ট হয়েছিল। এই শীর্ষ সম্মেলনে ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা একটি চূড়ান্ত ঘোষণার বিষয়ে সম্মত হয়। তবে ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জন্য এই ঘোষণাপত্রে রাশিয়ার নাম উল্লেখ করে নিন্দা জানানো হয়নি।
সম্মেলনের ঘোষণাসংক্রান্ত বিবৃতি নিয়ে বিরোধ এড়িয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টিকে বেছে নিয়েছিল ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্ররা; যদিও ব্যাপারটি ইউক্রেনকে কিছুটা ক্ষুব্ধ করে।
ভারত-কানাডার বিরোধ পশ্চিমা কূটনীতিকদের মধ্যে নানা উদ্বেগ-শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত-কানাডা বিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কোনো একটি পক্ষে অবস্থান নেওয়ার ঝুঁকির দিকটি।
অটোয়া-নয়াদিল্লির মধ্যকার উত্তেজনা চলতি সপ্তাহের শুরুতে নাটকীয়ভাবে বেড়ে যায়। গত সোমবার কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর দেশের পার্লামেন্টে শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেন। গত জুনে কানাডার পশ্চিমাঞ্চলে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন কানাডীয় নাগরিক হরদীপ। এ হত্যাকাণ্ডে ভারতের হাত থাকার অভিযোগ তোলেন ট্রুডো।
পার্লামেন্টে ট্রুডো বলেন, হরদীপ হত্যায় ভারতীয় এজেন্টদের জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তাঁর দেশের গোয়েন্দাদের কাছে আছে। কানাডার মাটিতে একজন কানাডীয় নাগরিককে হত্যার সঙ্গে কোনো বিদেশি সরকারের জড়িত থাকার বিষয়টি তাঁর দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন, যা অগ্রহণযোগ্য।
ট্রুডোর এমন বক্তব্যের পরই সোমবার কানাডায় ভারতের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংয়ের (র) প্রধানকে বহিষ্কার করে অটোয়া।
ট্রুডোর বক্তব্যকে অযৌক্তিক বলে প্রত্যাখ্যান করে ভারত। একই সঙ্গে অটোয়ার পাল্টা হিসেবে ভারতে নিযুক্ত কানাডার এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে নয়াদিল্লি।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত নিজেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। এই দেশগুলোকে ‘গ্লোবাল সাউথ’ বৈশ্বিক দক্ষিণ নামেও ডাকা হয়। এর মধ্যে অনেক দেশই ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের নিন্দা জানায়নি।
যুক্তরাষ্ট্র ও কিছু ইউরোপীয় দেশ এসব দেশের মন জয় করতে কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এই দেশগুলোকে বলছে, এ যুদ্ধ তাদের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।
পশ্চিমা কূটনীতিকেরা কোনোভাবেই চাইবেন না, ভারত-কানাডা বিরোধের জেরে তাঁদের এই প্রচেষ্টা ভেস্তে যাক। কমনওয়েলথভুক্ত দুটি দেশের বিরোধের জেরে উত্তর বনাম দক্ষিণের একটি লড়াই বেধে যাক। ট্রান্স-আটলান্টিক শক্তির সঙ্গে উন্নয়নশীল বিশ্বের একটা দ্বন্দ্ব তৈরি হোক।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হরদীপ হত্যার বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে উত্থাপন করেছেন ট্রুডো।
আপাতত যা দেখা যাচ্ছে, তা হলো কানাডার মিত্ররা অটোয়ার প্রতি সতর্কতার সঙ্গে সমর্থন বজায় রেখেছে।
হোয়াইট হাউস বলেছে, যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যার অভিযোগের বিষয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ নিয়ে কানাডার তদন্ত এগিয়ে নেওয়া, দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় শিখ সম্প্রদায়ের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠী রয়েছে। ফলে অটোয়া-নয়াদিল্লির বিরোধ যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লিভারলি বলেছেন, কানাডা যে গুরুতর অভিযোগ তুলেছে, তা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনবে তাঁর দেশ।
ক্লিভারলি বিবিসিকে বলেছেন, তিনি সোমবারই অভিযোগটি নিয়ে কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জোলির সঙ্গে কথা বলেছেন। কানাডা যা বলছে, তাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে যুক্তরাজ্য।
ভারতের সঙ্গে যুক্তরাজ্য তার বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করবে কি না, এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান ক্লিভারলি। তবে তিনি বলেছেন, ভবিষ্যতে কোনো পদক্ষেপের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সরকার কানাডার তদন্ত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।
ক্লিভারলি উল্লেখ করেন, কানাডা ও ভারত উভয়ই যুক্তরাজ্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দেশ দুটি কমনওয়েলথেরও সদস্য।
অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, অটোয়া যে অভিযোগ তুলেছে, সে বিষয়ে ক্যানবেরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। ক্যানবেরার উদ্বেগের কথা ইতিমধ্যে ভারতের উচ্চপর্যায়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আপাতত যা প্রতীয়মান হচ্ছে, তা হলো, পশ্চিমারা এখন অপেক্ষা করবে। তারা হরদীপ হত্যার তদন্তের অগ্রগতির দিকে নজর রাখবে।
কানাডার গোয়েন্দারা এই হত্যার বিষয়ে যেসব তথ্য জানেন, তা তাঁরা অটোয়ার কিছু মিত্রদেশের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পারেন।
হরদীপ হত্যায় ভারতের হাত থাকার বিষয়ে দৃঢ় প্রমাণ পাওয়া গেলে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পশ্চিমা শক্তিগুলোকে অটোয়া বা নয়াদিল্লির মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নিতে হবে।
অতীতে রাশিয়া, ইরান বা সৌদি আরবের মতো দেশের বিরুদ্ধে যখন নিজ ভূখণ্ডের বাইরে রাষ্ট্রীয় মদদে কোনো হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, তখন তার নিন্দা জানাতে দেখে গেছে পশ্চিমাদের। এই তালিকায় ভারতের নাম উঠুক, তা চাইবে না পশ্চিমারা।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সাইফুল সামিন