যুদ্ধ–বিক্ষোভ ও মন্দার আশঙ্কায় শেষ হয়েছে ২০২২ সাল। নতুন বছর আশার আলো নিয়ে এলেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এখনো চোখ রাঙাচ্ছে। বিশেষত রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের লাগাম টানা, ইউরোপের জ্বালানিসংকট, মন্দা পরিস্থিতি, সামরিকায়ন, চীনে করোনার নতুন করে বিস্তারের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে নতুন বছরের শুরু থেকেই। তবে ব্রাজিলে ক্ষমতার পালাবদল জলবায়ু সুরক্ষার বিষয়ে আশার সঞ্চার করেছে। ২০২৩ সালের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার কয়েকটি বিষয় নিয়ে এবারের আয়োজন:
নতুন বছরে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ কি শেষ হচ্ছে? যুদ্ধের ১০ মাস পেরিয়ে এসে ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ভ্লাদিমির পুতিন করমর্দন করছেন, শান্তির বার্তা দিচ্ছেন; এমন দৃশ্য হয়তো অনেকেই কল্পনা করতে পারছেন না। তবে রাজনীতি ও কূটনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। তাই শান্তি আলোচনায় সফলতার সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
ইউক্রেনের চাওয়া, যুদ্ধাপরাধের দায়ে রাশিয়া ও রুশ নেতাদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার নিশ্চিত করা। দখল হয়ে যাওয়া ভূমি পুনরুদ্ধার করা। তবে ইউক্রেন থেকে সেনা সরিয়ে নিতে নারাজ রাশিয়া। ১৯৪৫ সালের মতো আরেকবার শূন্য হাতে যুদ্ধ শেষ করতে চাইবে না মস্কো। এ চাওয়া নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় আলোর মুখ দেখছে না শান্তিপ্রক্রিয়া।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বাস্তবসম্মত কৌশল হতে পারে যুদ্ধবিরতি। তবে যুদ্ধবিরতি রাশিয়ার জন্য যতটা লাভজনক, ইউক্রেনের জন্য ততটা না–ও হতে পারে। কেননা গত ১০ মাসে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশবাহিনী অনেকটাই বিচ্ছিন্ন ও আকাশপথে হামলানির্ভর হয়ে পড়েছে। আর পর্তুগালের আয়তনের সমান ইউক্রেনীয় ভূমি দখল করে নিয়েছে রাশিয়া।
এদিকে শীত মৌসুম এসে যুদ্ধ পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে। ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থায় একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা রাশিয়াকে এগিয়ে রাখছে। তীব্র শীত মোকাবিলার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইউক্রেন সরকার। শীত শেষে গ্রীষ্ম কিংবা শরতে যুদ্ধের মোড় ঘুরতে পারে। তত দিন যদি পশ্চিমারা অর্থ ও অস্ত্রসহায়তা অব্যাহত রাখে, তবেই ইউক্রেন টিকে থাকবে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে পুরো ইউরোপ তীব্র জ্বালানিসংকটে পড়েছে। জ্বালানি ও খাবারের দাম বেড়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করা, মন্দা থেকে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখা নতুন বছরে ইউরোপের প্রধান চ্যালেঞ্জ। রুশ তেল–গ্যাসে নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা ইউরোপীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এটা করতে গিয়েই এসব দেশে জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। বিকল্প উৎস থেকে তেল–গ্যাস কিনতে হচ্ছে। যার বাড়তি ব্যয় মেটাতে হচ্ছে ভর্তুকি দিয়ে। পকেট খালি হচ্ছে ভোক্তাদের, করদাতাদের। এ পরিস্থিতি ইউরোপে জন–অসন্তোষ বাড়াচ্ছে। চাপে ফেলছে গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, ২০২৫ সালের আগে ইউরোপে জ্বালানির দাম স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাই নির্বাচন সামনে রেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ফিনল্যান্ড, গ্রিস ও পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীনদের। কেননা অর্থনৈতিক সংকটের জেরে ইতালি ও যুক্তরাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের উদাহরণ তাঁদের চোখের সামনেই রয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাছে সহায়তা বাড়ানোর দাবি তুলেছে হাঙ্গেরি ও বেলজিয়াম। তাই নতুন বছরে এসব সমস্যার কার্যকর সমাধান খুঁজতে গলদঘর্ম হতে হবে ইউরোপীয় নেতাদের।
করোনার উদ্ভব চীনে হলেও শূন্য করোনা নীতির কারণে ভাইরাস মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছিল বেইজিং। বিদায়ী বছরের শেষভাগে এসে চীনজুড়ে নতুন করে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। তাই নতুন বছরে করোনার লাগাম টানা চীনের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে শূন্য করোনা নীতির কারণে দেখা দেওয়া অর্থনৈতিক চাপ মোকাবিলা করতে হবে দেশটিকে।
বিদায়ী বছরে তৃতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ নিশ্চিত করেছেন সি চিন পিং। রাজনৈতিক ক্ষমতা বেড়েছে তাঁর। তবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে পশ্চিমাদের অভিযোগ, তাইওয়ান ইস্যুতে চীনের অখণ্ডতা ধরে রাখার চাপ কঠোর হাতে মোকাবিলা করতে হবে তাঁকে।
এ জন্য গত অক্টোবর থেকে একের পর এক রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সি চিন পিং। সৌদি আরবে সফরে গেছেন। এসবের মধ্য দিয়ে তিনি বিশ্বরাজনীতিতে ভারসাম্য ধরে রেখে চীনের স্বার্থ আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইরানের বিক্ষোভ ও তা দমনের নামে সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে ইরানের ওপর দেশি–বিদেশি চাপ। এ চাপ এতটাই প্রখর যে ইরানে ৪৩ বছরের ইসলামিক শাসন নিয়ে রীতিমতো প্রশ্ন উঠেছে। এর মধ্যে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধে মিত্রদেশ রাশিয়াকে সহায়তা দিচ্ছে তেহরান।
এ পরিস্থিতিতে চলমান যুদ্ধে পশ্চিমারা ‘বিজয়ী’ হলে সংকটে পড়বেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। ইসলামপন্থী এ নেতা পশ্চিমাদের চোখরাঙানি উপেক্ষা, নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন। তাই নতুন বছরে ইরানিদের ভবিষ্যৎ শুধু নিজেদের ওপর নয়, আরও অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২৪ সালে। ইতিমধ্যে দেশটিতে নির্বাচনী হাওয়া বইছে। পরবর্তী মেয়াদে জো বাইডেন নির্বাচনে দাঁড়াবেন কি না, তা জানা না গেলেও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আবারও ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ট্রাম্পের ফিরে আসা দেশটির গণতন্ত্রের জন্য, উদারপন্থীদের জন্য বড় ধাক্কা হবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই।
তাই ট্রাম্পকে মোকাবিলায় ২০২৩ সালজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি সরগরম থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হতে পারে ক্যাপিটল ভবনে হামলার বিষয়ে ট্রাম্পকে বিচারের মুখোমুখি করা। ২০১৮, ২০২০ ও ২০২২ সালের প্রেসিডেন্ট ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র হারেনি। ২০২৪ সালেও হারবে না—আশাবাদ এমনই। এটা নির্ভর করবে ২০২৩ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ওপর।
২০২৩ সাল কি সবচেয়ে উষ্ণ বছর হবে? গ্রিনহাউস গ্যাসের নির্গমন কি কমবে না? এসব প্রশ্নের উত্তর বিদায়ী বছরে খোঁজা হয়েছে। নতুন বছরের খোঁজা হবে। ২০২২ সালে ভারত থেকে ইউরোপ পর্যন্ত দাবদাহে পুড়েছে। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে পাকিস্তানে। আফ্রিকার কোটি কোটি মানুষ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে পড়েছে। এসব হয়েছে জলবায়ু সুরক্ষায় উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর উদাসীনতার ফলে।
২০২২ সালে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ–২৭) বড় কোনো আশা দেখাতে পারেনি। ধনী দেশগুলো গরিব ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে অর্থ দিয়েই দায়দায়িত্ব এড়াতে তৎপর। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর বিষয়ে তাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা নেই। তাই ২০২৩ সালজুড়ে জলবায়ু সুরক্ষার বিষয়টি আলোচনায় থাকবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী রেখে যেতে গরিব ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো আগামী ডিসেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠেয় কপ–২৮–এ সরব থাকবে।
রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তাভাবনা আমূল বদলে দিয়েছে। রাশিয়ার পারমাণবিক হামলার ভয়ে ইউরোপের দেশগুলো সামরিকায়নে ব্যয় বাড়িয়েছে। ঐতিহাসিক নীতি বদলে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে যাচ্ছে সুইডেন ও ফিনল্যান্ড।
পিছিয়ে নেই দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোও। ২০২২ সালে নতুন প্রতিরক্ষা গাইডলাইন অনুমোদন করেছে জাপান। সীমান্ত সুরক্ষা জোরদার করেছে দক্ষিণ কোরিয়াও। তাদের ভয় চীন ও উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে।
এ ছাড়া চীন–তাইওয়ান–যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ এ অঞ্চলে নতুন করে সংকটের জন্ম দিয়েছে। এর জের টানতে হবে ২০২৩ সালেও। তাই নতুন বছরের বড় একটি চ্যালেঞ্জ ইউরোপের পাশাপাশি এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তার কৌশল খোঁজা।
নতুন বছরের শুরুতে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব নেবেন লুলা দি সিলভা। কট্টর ডানপন্থী জইর বলসোনারোর বিদায়ে পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজন বন রক্ষা ও জলবায়ু ইস্যুতে আশার আলো দেখছেন অনেকেই। সেই সঙ্গে ব্রাজিলের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির বার্তা দিয়েছেন বামপন্থী লুলা। তাই নতুন বছরে বলসোনারোর কট্টর নীতি থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তির পথ রচনা করতে হবে তাঁকে।
ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ব্রাজিলের ভাবমূর্তি ফেরানোর চেষ্টা শুরু করেছেন লুলা। দায়িত্ব নেওয়ার আগেই কপ–২৭ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। ২০২৩ সালজুড়ে তাঁর কাছ থেকে এমন নানা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দেখা যেতে পারে।
এ ছাড়া আফ্রিকার মানুষের ক্ষুধা মেটানো, জীবনমানের উন্নয়ন, ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ফিরে আসায় ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, বিশ্বজুড়ে শরণার্থীদের জীবন বাঁচানো নতুন বছরের চ্যালেঞ্জের তালিকায় থাকবে।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান