গৃহীত হলো দিল্লি ঘোষণাপত্র। সর্বসম্মতিক্রমে। ঘোষণাপত্রে যুক্ত হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গ। লেখা হলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বলা সেই কথা, ‘এটা যুদ্ধের যুগ নয়’। কিন্তু যুদ্ধ প্রসঙ্গে রাশিয়ার নাম অনুচ্চারিতই থাকল। দীর্ঘ টালবাহানার পর জি-২০-এর সভাপতি দেশ হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজেই আজ শনিবার ভারত মন্ডপমে এই ‘আনন্দ সংবাদ’ ঘোষণা করেন।
মোদি বলেন, ‘বন্ধুগণ, এই মুহূর্তের শুভ সংবাদ এটাই যে কঠোর পরিশ্রম শেষে আপনাদের সবার সহযোগিতায় নিউ দিল্লি জি-২০ ঘোষণাপত্র গ্রহণে সবাই সম্মত হয়েছে।’
বালি সম্মেলন থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জি-২০-এর গলার কাঁটা। যুক্তরাষ্ট্রসহ জি-৭ গোষ্ঠীভুক্ত সদস্যদেশগুলোর দাবি ঘোষণাপত্রে ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সরাসরি দায়ী করতে হবে রাশিয়াকে। এর বিরুদ্ধে এককাট্টা রাশিয়া ও চীন। দুই পক্ষের এই অনড় মনোভাবের কারণে বালি ঘোষণাপত্রের চরিত্র ছিল ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’র মতো। সেই পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত। জি-৭ ও রাশিয়া-চীনের পরস্পরবিরোধী অবস্থানের জন্য ভারতের সভাপতিত্বে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সম্মেলনে সর্বসম্মতভাবে কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি। দিল্লিতে শীর্ষ সম্মেলন ঘিরেও তাই সংশয়ের মেঘ ছেয়েছিল ঘোষণাপত্র নিয়ে। ঘোষণাপত্র গৃহীত না হলে সেটা হতো ভারতের নেতৃত্বের পক্ষে একটা বড় ধাক্কা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না’ গোছের সমাধান সূত্রের খোঁজ দিতে পারলেন ভারতীয় কূটনীতিকেরা। ঘোষণাপত্রের কয়েকটি অধ্যায় লেখা হলো নতুন করে, যেখানে পরিষ্কারভাবে বলা হলো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রসঙ্গও ঘোষণাপত্রে বিস্তারে উল্লেখ করা হলো। কিন্তু রাশিয়ার নাম কোথাও কোনোভাবে উচ্চারণ করা হলো না।
ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রের খবর, ৩৭ পৃষ্ঠার ঘোষণাপত্রকে সর্বসম্মত করে তুলতে ‘পৃথিবী, জনগণ, শান্তি ও সমৃদ্ধি’ শীর্ষক অংশের চারটি অনুচ্ছেদ নতুন করে লিখতে হয়েছে। প্রতিটি শব্দ খুঁটিয়ে দেখে প্রতিটি দেশের শেরপারা তা অনুমোদন করেছেন। যার শেষ অনুচ্ছেদে রাখা হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সেই কথাটি, যা তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বলেছিলেন, ‘এটা যুদ্ধের যুগ নয়’ (টুডেজ এরা মাস্ট নট বি অব ওয়ার)।
ইউক্রেন যুদ্ধের উল্লেখ করে ঘোষণাপত্রের অষ্টম অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ সভায় গৃহীত প্রস্তাবই মান্য। কোনো দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত নয়। গায়ের জোরে ভৌগোলিক সীমানার পরিবর্তন নয়। পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার বা ব্যবহারের হুমকি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ইউক্রেন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ও জনগণের দুর্দশার উল্লেখ করে ঘোষণাপত্রের দশম অনুচ্ছেদে লেখা হয়েছে, এই যুদ্ধ খাদ্য, শক্তি নিরাপত্তা, সরবরাহ শৃঙ্খল, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করেছে। মূল্যবৃদ্ধি গগনচুম্বী করে তুলেছে। প্রবৃদ্ধি নষ্ট করেছে। চরম সংকট সৃষ্টি করেছে কম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয়। কোভিডের ছোবল থেকে এসব দেশ এখনো মুক্ত হতে পারেনি।
ঘোষণাপত্রে এরপরই বলা হয়েছে, জাতিসংঘ সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কোনো স্বাধীন দেশের আঞ্চলিক অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গিয়ে ভৌগোলিক অঞ্চল দখলের হুমকি দেওয়া বা বাহিনী মোতায়েন করা থেকে সব দেশ বিরত থাকবে। স্বাধীন দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাই যেন আন্তর্জাতিক আইনের নীতি মেনে চলে। বিবাদের শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় ব্রতী হয়। সংলাপ ও কূটনীতির ওপর নির্ভরশীল হয়। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী ইউক্রেনে শান্তি ফেরাতে সচেষ্ট হওয়ার কথা জানিয়ে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, সেই লক্ষ্য পূরণে জি-২০-এর ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ আখ্যান কার্যকর হোক। ঘোষণাপত্রের এই অংশ শেষ করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির সেই বাক্যটি দিয়ে, ‘এটা যুদ্ধের যুগ নয়।’ এই একটি বাক্যই ১৪তম অনুচ্ছেদ।
ভারতের সরকারি সূত্র জানিয়েছে, ১৫০ ঘণ্টা ধরে কাটাছেঁড়ার পর এই ঘোষণাপত্রে সব সদস্যদেশ সম্মত হয়েছে। ভারতের কাছে এটা ছিল এক মস্ত চ্যালেঞ্জ, যেহেতু যুযুধান দুই শিবিরকে এক কাতারে দাঁড় করানো ছিল কঠিন ব্যাপার। জি-২০-কে ভূরাজনৈতিক আঙিনা থেকে বের করে উন্নয়নমূলক করে তোলা ছিল ভারতের লক্ষ্য, যা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময় থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। অর্থনীতি, উন্নয়ন ও সহযোগিতাকে আবার এই গোষ্ঠীর মূল স্রোতে নিয়ে আসা গেছে বলে ভারতীয় নেতৃত্বের দাবি। ওই সূত্রের কথায়, ঘোষণাপত্রে ‘ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শব্দবন্ধের বদলে ‘ইউক্রেনে যুদ্ধ’ শব্দ মুশকিল আসান হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়াকে এক ঘরে হতে না দিয়ে ঘোষণাপত্র সর্বসম্মতভাবে গ্রহণের বিষয়টি ‘মিত্র’ ভারতের পক্ষে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে ভারত সসম্মানে উত্তীর্ণ বলে এই মহলের দাবি।
দিল্লি শীর্ষ সম্মেলনেই জি-২০-এর বহর বাড়ল। গোষ্ঠীর স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্ত হলো আফ্রিকা ইউনিয়ন। প্রধানমন্ত্রী মোদি ‘গ্লোবাল সাউথ’ ও আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে জোটে আনার যে প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন, তা বাস্তবায়িত হলো।