বসনিয়া, ট্রান্সনিস্ত্রিয়া, চেচনিয়ার পর রুশ জাতীয়তাবাদীদের পরবর্তী বড় রণক্ষেত্র হয় প্রথমে ক্রিমিয়া, পরে দোনেৎস্ক-লুহানস্ক।
পুতিন শুরুতে তাঁর ইউক্রেন অধ্যায়ের নাম দিয়েছিলেন ‘বিশেষ অভিযান’। যেকোনো ‘অভিযান’ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের চেয়ে কম কিছু বোঝায়। কিন্তু ইউক্রেন পরিস্থিতি বহু আগেই পুরোদস্তুর যুদ্ধের আদল নিয়েছে। রুশ উগ্র জাতীয়তাবাদীরাও তাই চাইছে কিংবা তার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু তাদের উৎসাহ পুতিনকে কোথায় নিয়ে থামাবে—সে প্রশ্ন উঠেছে। পুতিনের মতোই এই যুদ্ধফাঁদে পড়েছে ইউরোপ-আমেরিকার করদাতারাও। কিন্তু পুতিন ও বাইডেন আসলে কাদের যুদ্ধ লড়ছেন? বিশ্ব কতটা চিনল, জানল এ যুদ্ধের পেছনের ‘যোদ্ধা’দের?
রুশ জাতীয়তাবাদীদের বহু মঞ্চ আছে। প্রতিপক্ষরা এদের সবাইকে এক নামে ‘রুশ দক্ষিণপন্থী’ বলে। ১৯৯০-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সাম্যবাদীরা ছত্রখান হয়ে যাওয়ার পর রাশিয়ার রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণ করে জাতীয়তাবাদীরা। ইয়েলৎসিন ও পুতিনের দীর্ঘ একনায়কতন্ত্রে সেই জাতীয়তাবাদের ভেতর এখন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ধারা হিসেবে নেতৃত্বে আছে সবচেয়ে উগ্র অংশ।
কেউ কেউ এরা এত দিন ছিল ‘জাতীয় গণতন্ত্রী’ নামে। কেউ নিজেদের বলে ‘দনবাসের সাবেক সৈনিক’। বাস্তবে এরা অধিকাংশ শ্বেতাঙ্গ ‘রুশ শ্রেষ্ঠত্ববাদী’। যাদের ছত্রচ্ছায়ায় আছে ‘নয়া নাৎসিরাও’। ২৩ বছর রাশিয়া শাসনে এরাই পুতিনের শক্ত ভিত।
এ রকমই একজন আইগর গিরকিন। ভ্লাদিমির পুতিন, আলেক্সান্দর দাগিনের পাশাপাশি আইগর গিরকিন এখন রুশ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নতুন সামাজিক নায়ক। ইউক্রেনের দোনেৎস্কে ঢুকে রাশিয়ার হয়ে দীর্ঘ গেরিলাযুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন গিরকিন। সে সময় তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘স্ট্রেলকভ’ (শুটার)। ‘দনবাস পিপলস মিলিশিয়া’ ছিল এই রুশদেরই বাহিনী। গিরকিনকে বলা হতো দনবাসের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এদের হাতেই ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই দোনেৎস্কের আকাশে মালয়েশিয়ার বেসামরিক বিমান (এমএইচ ১৭) গুলিবিদ্ধ হয় এবং ২৯৮ জন নিরপরাধ মানুষ খুন হয়। হতভাগ্যদের বড় অংশ ছিল নেদারল্যান্ডসের নাগরিক।
ওই বিমান ভূপাতিত হওয়ার পর গিরকিনই রুশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ভিকে’তে তার কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। ডাচরাও তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্টভাবে বলেছিল—গিরকিনরা ইউক্রেনের বিমান ভেবে ওই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটিয়েছে রুশ মিসাইল দিয়ে। তার আগে ক্রিমিয়া দখলের পটভূমি তৈরিতে সেখানে ঢুকে রুশপন্থী ‘স্বেচ্ছাসেবী’দের জড়ো করেছিল এই গিরকিনের বাহিনী।
আইগর গিরকিনের জীবনকাহিনির নির্মোহ পাঠ যে কাউকে কেবল ইউক্রেনের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’-এর প্রকৃত সূচনাপর্বই জানাবে না—বসনিয়ায় সার্বদের হয়ে রুশ সহযোগিতার দীর্ঘ বিবরণও দেবে। খোদ গিরকিন ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তাঁর বসনিয়া ডায়েরিতে সেসব লিখে রেখেছেন। এফএসবি (কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা) এবং জিআরইউ (রুশ সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ)-এর হয়ে এদের বিপুল তৎপরতা ছিল চেচনিয়ায়; তারও আগে মলদোভায়—সেখানকার ট্রান্সনিস্ত্রিয়া অঞ্চল কেড়ে নিতে। এখনো ট্রান্সনিস্ত্রিয়ায় প্রায় দুই হাজার রুশ সৈন্য আছে স্থানীয় রুশভাষীদের নিরাপত্তার নামে। অথচ এলাকাটি একটি স্বাধীন দেশের।
বসনিয়া, ট্রান্সনিস্ত্রিয়া, চেচনিয়ার পর রুশ জাতীয়তাবাদীদের পরবর্তী বড় রণক্ষেত্র হয় প্রথমে ক্রিমিয়া, পরে দোনেৎস্ক-লুহানস্ক। এসব এলাকায় গত দশকে গেরিলা কায়দায় শুরু করা সেসব ‘অশান্তির’ই জের টানছেন এখন পুতিন। ক্রিমিয়ায় রুশপন্থী নেতা সের্গেই আকসইনভের উপদেষ্টা ছিলেন গিরকিন। এসব থেকে স্পষ্ট, ইউক্রেন যুদ্ধ কেবল ২০২২ সালে শুরু হয়নি।
পুতিন আসলে রুশ এফএসবির গিরকিনদের যুদ্ধই লড়ছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমসমূহ এই যুদ্ধকে বাইডেন বনাম পুতিন ছকে ফেলতে মরিয়া। তাতে করে আড়াল হচ্ছে গিরকিনদের ‘গল্প’। পুতিনও গিরকিনদের জাতিগত উন্মাদনা আড়াল করতে ইউক্রেনে মিসাইল ছোড়ার আগে সেখানকার নারী-পুরুষদের ‘নাৎসি’ হিসেবে দোষারোপ করছেন। যুদ্ধবিদ্যারই পুরোনো কৌশল এটা: খুনের আগে প্রতিপক্ষকে কলঙ্কিত করে নাও!
আপাতত এটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য—ইউক্রেনে হামলা এককভাবে পুতিনের ঘোষণায় শুরু হয়েছে এবং চলছে। তবে এমনও ভাষ্য আছে, পুতিনকে সামনে রেখে রুশ দক্ষিণপন্থীরাই এ যুদ্ধ এগিয়ে নিচ্ছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়াকে নিজেদের মানচিত্রে সংযুক্তির পর ইউক্রেনের আরও কিছু স্থানে রুশভাষীদের সংঘবদ্ধ করে এরাই দেশটিতে ঢুকে পড়ার জন্য পুতিনকে প্রলুব্ধ করেছে, চাপ দিয়েছে। ২০১৬ সালে দোনেৎস্ক ও ক্রিমিয়ায় বিভিন্ন গোপন অভিযানে যুক্ত গিরকিন ও তাঁর রুশ সাবেকেরা গড়ে তোলেন ‘রুশ ন্যাশনাল মুভমেন্ট’ নামের সংগঠন, যার লক্ষ্য ইউক্রেন, বেলারুশসহ সব ‘রুশ ভূমি’ একত্র করা। পুতিনের এখনকার ‘বিশেষ অভিযান’ সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। বেলারুশও সেই উদ্যোগে শামিল হলো সর্বশেষ।
তবে দনবাসসহ ইউক্রেনের রুশভাষী জনপদগুলো রাশিয়া ইতিমধ্যে নিজের মানচিত্রে যুক্ত করে নিলেও ইউক্রেনের বিশেষ অভিযানে ঝুঁকিতে পড়েছে পুতিনের রাজনৈতিক ভাগ্য। ইজ্জত বাঁচাতে তাঁকে এখন পারমাণবিক বোমা ব্যবহারের কথাও ভাবতে হচ্ছে। স্বদেশে জাতীয়তাবাদীরা তাঁর সামনে দুটি বিকল্প বেঁধে দিয়েছে: যুদ্ধে জিতে আসো; তাতে সমস্যা দেখলে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করো। অর্থাৎ রুশ দক্ষিণপন্থীরা চাইছে যেকোনো মূল্যে ইউক্রেন দখল।
কেবল ইউক্রেনে নয়, ‘রুশ সাম্রাজ্যে’র পতাকা ওড়াতে চায় তারা আশপাশের স্লাভ ও অ-স্লাভ আরও অঞ্চলে। যা হবে নৃতাত্ত্বিকভাবে ‘ঐক্যবদ্ধ স্লাভ অঞ্চল’—আর সাংস্কৃতিকভাবে ‘রুশ বিশ্ব’। যে আকাঙ্ক্ষার সাংস্কৃতিক ছাপ ছিল ১৯১৭-এর ‘বলশেভিক’দের মধ্যেও। তারই নতুন সংশোধিত নাম দিয়েছে রাশিয়াপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ‘ইউরেশিয়া’। তাদের একাংশ একে ‘নভোরোশিয়া’ও বলে।
এই ইউরেশিয়া বা নভোরোশিয়া ধারণার ভেতর রয়েছে স্লাভদের প্রথম রাষ্ট্র ‘কিয়েভান রুশ’কে ফিরে পাওয়ার বাসনা। আজকের রুশ, বেলারুশ ও ইউক্রেন নিয়ে গড়ে ওঠা নয় থেকে তেরো শতাব্দীর ওই রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল কিয়েভ। কেবল এ কারণেই মস্কোর জাতীয়তাবাদীদের কাছে নিজ রাজধানীর চেয়েও কিয়েভে পৌঁছানো বাড়তি গুরুত্বের, গৌরবেরও বটে। ১৯৯০-এ খুইয়ে ফেলা ‘পরাশক্তি’র মর্যাদা ফিরে পেতে লড়ছে তারা। পুতিন যেসব ভাষণে ইউক্রেনকে ‘বৃহত্তর রুশ’ পরিচয়ের অংশ বলেন—তাতে ঐতিহাসিক অনেক ইঙ্গিত ও সত্যতা আছে।
কিন্তু মুশকিল হলো, পুতিনের ‘বিশেষ অভিযান’ স্থলপথে কিয়েভ পৌঁছাতে পারেনি। ‘কিয়েভান রুশের’র স্বাপ্নিকেরা তাই ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’ চাইছে। ওই লক্ষ্যে রাজনৈতিক চাপ তৈরি করছে। এর পেছনে আছে বৈশ্বিক–স্লাভবাদ এবং রাশিয়ার ভেতরে-বাইরে সক্রিয় রুশ ভাষার প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা। যাতে মিশে আছে জাতিগত ও ভাষাগত—দুই ধরনের সাম্প্রদায়িক আকাঙ্ক্ষা। বিস্ময়ের দিক, ইউক্রেন যুদ্ধের ধারাভাষ্যকারদের বয়ানে মার্কিন বা রুশ ‘সাম্রাজ্যবাদ’ শব্দ যতটা মেলে, ততটাই অনুপস্থিত চলতি যুদ্ধের সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক এই জিঘাংসার বিবরণ।
মস্কোতে যুদ্ধবিরোধীদের রাস্তায় দাঁড়ানো কঠিন। সর্বাত্মক যুদ্ধপন্থীদের সেই সমস্যায় পড়তে হয় না। রাশিয়ার ‘মহান ঐতিহ্য’ বাঁচাতে এরা ইউক্রেনে পারমাণবিক বোমা ফেলার পক্ষে জনমত গড়ছে এখন। ২৩ বছরের বিগত শাসনে পুতিন ও এই ছদ্ম স্লাভ শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের পরস্পরকে দরকার ছিল। ইউক্রেনে যুদ্ধ করতে পুতিনের ‘রিজার্ভ’ সেনা তলবের সিদ্ধান্তও এই জাতিবাদীরা স্বাগত জানিয়েছে। এদের গোপন ভয়—ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় এ অঞ্চলের অ-রুশ সব জাতিসত্তার স্বাধিকার চৈতন্যকে জাগ্রত করে তুলবে।
রাশিয়ার প্রায় ২০ ভাগ মানুষ জাতিতে রুশ নয়। গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঞ্চল আছে এদের হাতে। এ রকম শক্তিগুলোকে ‘রুশ বিশুদ্ধতা’র পক্ষে হুমকি বলে মনে করে গিরকিনরা। রাশিয়ার অর্থডক্স চার্চ যে ইউক্রেন আগ্রাসনকে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ বলছে, তারও কারণ ওই নৃতাত্ত্বিক জাতিবাদ। ইউক্রেনের অর্থডক্সদের সঙ্গে তার বিবাদের হেতু কেবল এভাবেই বোঝা সম্ভব।
শ্রেষ্ঠত্ববাদ কায়েমের এ যুদ্ধে রুশ দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে ইউরোপের অন্যান্য উগ্র জাতীয়তাবাদীদের বেজায় মিল। জার্মান দক্ষিণপন্থী এএফডি (অল্টারনেটিভ ফর জার্মান) দলের কয়েক এমপি অতিসম্প্রতি ইউক্রেনের রুশ দখলকৃত এলাকা দনবাসে ঘুরতে গিয়েও পারলেন না ২১ সেপ্টেম্বর সেখানে ইউক্রেনের পাল্টা হামলার কারণে। এই সফর রুশদের সহযোগিতাতেই ঘটতে যাচ্ছিল।
রুশরা সুইডেনের সাম্প্রতিক নির্বাচনে অবিশ্বাস্যরকম ভালো করা এসডি (সুইডেন ডেমোক্র্যাট) পার্টিরও সমর্থক। কারণ, এরা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ঐক্যের বিপক্ষে। ইউরোপের প্রত্যেক দেশে রুশদের এ রকম ‘ট্রোজান হর্স’ আছে। এদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য মস্কোর নানান গোপন প্রচেষ্টার কথাও শোনা যায় এবং নিজ নিজ দেশে এরা সবাই নির্বাচনে ভালো করছে! পুতিন এ রকম শক্তিগুলোর কাছে ‘প্রকৃত নেতা।’ এ বছর এপ্রিলে হাঙ্গেরিতে ফিদেজ পার্টি জেতার পর সংবাদমাধ্যমগুলো সরাসরি লিখেছে, ‘হাঙ্গেরি বেছে নিল পুতিনের বন্ধু ভিক্তর অরবানকে’।
ইউক্রেনের সঙ্গে সীমান্ত থাকলেও দেশটির চলতি দুঃসময়ে ভিক্তর অরবানের কণ্ঠে তেমন সমবেদনা শোনা যায় না। কয়েক বছর ধরেই ফিদেজ পার্টি ইইউ থেকে বের হওয়ার প্রচার চালাচ্ছে। পুতিনের এটা বিশেষ পছন্দ। সর্বশেষ ভোটে ৫৩ শতাংশ ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এল তারা।
পুতিনের আরও পছন্দের লোক আছে আশপাশে। ইতালির ‘লিগা’র (লিগা পার সালভিনি প্রিমিয়ার) মাত্তো সালভিনি ২০১৯-এ পুতিনকে ‘বর্তমান বিশ্বের সেরা রাষ্ট্রনায়ক’ বলেছিলেন। গত মাসের নির্বাচনে যদিও সালভিনির দল মাত্র ৯ ভাগ ভোট পেয়েছে, কিন্তু তাতে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে একই আদর্শের এবং একই জোটের জর্জিয়া মেলোনি। ইতালিতে জর্জিয়ার বিজয়কে ‘ইউরোপে পুতিনের বিজয়’ হিসেবেও দেখা যায়।
২০১৮ সালে নির্বাচন রাশিয়ায় নতুন মেয়াদে পুতিনের শাসন শুরু হলে জর্জিয়া দ্ব্যর্থহীনভাবে ‘সঠিক নেতা’ বেছে নেওয়ার জন্য রুশদের অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেন। একই ধরন ফ্রান্সের নতুন দক্ষিণপন্থী তারকা লা পেনেরও। ২০১৪ সালে পুতিনের ক্রিমিয়া দখল সমর্থন করেছিলেন তিনি। গত এপ্রিলের নির্বাচনে দ্বিতীয় হলেও ৪০ ভাগের বেশি ভোট পান লা পেন। একই নির্বাচনের প্রথম দিককার আরেক প্রার্থী এরিক জেমুর পুতিনপ্রেমে লা পেনের চেয়েও এক ধাপ এগিয়ে। ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতার সময় তিনি নিজেই ‘ফ্রান্সের পুতিন’ হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
এখন অবশ্য সেই মন্তব্যের ইতিহাস লুকিয়ে রাখতে চান। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্দার ভুসিক অবশ্য সে রকম লুকোছাপায় নেই। সার্বিয়ার দক্ষিণপন্থী ‘র্যাডিক্যাল পার্টি’র সাধারণ সম্পাদক হন ১৯৯৫ সালে; প্রেসিডেন্ট হন ২০১২ সালে। ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর যুদ্ধাপরাধী স্লোবোদান মিলোসেভিচের তথ্যমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন ভুসিক। ১৯৯৫-এর ২০ জুলাই ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘একজন সার্বের মৃত্যুর বিপরীতে ১০০ জন মুসলমানকে হত্যা করা হবে।’ রাশিয়া ও পুতিনের প্রতি তাঁর পক্ষপাত প্রকাশ্য।
ইউরোপে পুতিনের সবচেয়ে বড় বন্ধু মনে করা হয় ভুসিককে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞায় নেই তাঁর সমর্থন। এপ্রিলের নির্বাচনে তিনিও ৬০ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতলেন। ভুসিক সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউজম্যাক্স টিভিকে বলেছেন, বিশ্ববাসীর উচিত পুতিনের পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া। পুতিন ও ভুসিকের ঘনিষ্ঠতাকে যাঁরা জানেন, তাঁরাও এ বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গেই নেবেন।
ইউক্রেনে রুশ হামলায় মৃত শিশুদের সারি ইউরোপের দক্ষিণপন্থীদের সাময়িক কিছুটা বিব্রত করলেও—যৌথভাবে রাজনীতিতে বাড়ছে তারা। এ রকম সবার কাছে পুতিনের শাসন-মডেল খুব পছন্দ। হাঙ্গেরিতে ভিক্তর ক্ষমতায় আছেন চার দফা। সার্বিয়ায় ভুসিক উপপ্রধানমন্ত্রী থেকে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত নানান পদে আছেন ১১ বছর হলো। পুতিন যেভাবে কর্তৃত্ববাদ, পরিচয়ের রাজনীতি এবং খ্রিষ্টানত্বকে মিশিয়ে দুই দশক পেরিয়ে বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে ক্ষমতায় আছেন, ইউরোপের দক্ষিণপন্থীদের কাছেও সেটাই আরাধ্য মডেল।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেওয়া নয়, নিজ নিজ দেশে আলাদাভাবে এরা পুতিনের মতো ‘নায়ক’ হতে চায়। সামাজিক ন্যায়বিচার এবং উদারগণতন্ত্রী ধারণায়ও বেশ অস্বস্তি তাদের। সেই সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাটদেরও বিরোধী তারা। এসবই পুতিনের সঙ্গে তাদের মৈত্রীর শর্ত তৈরি করেছে। এ রকম শর্তেই ট্রাম্প ও পুতিনের বন্ধুত্ব হয়। আপাতত যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প না থাকলেও ইউরোপজুড়ে অনেক ‘ট্রাম্প’ আসছে।
এ রকম সব দক্ষিণপন্থীর লড়াই–ই মূলত পুতিন লড়ছেন ইউক্রেনে। কিন্তু তিনি হারলে কেবল তাঁকেই যেতে হবে—আর জিতলে সমগ্র ইউরোপে শুরু হবে কর্তৃত্ববাদের নতুন সুনামি। যার অপর নাম হতে পারে ‘উদার গণতন্ত্রের ধীরলয়ের মৃত্যু’। নিশ্চিতভাবে সেটা পারমাণবিক বোমার চেয়ে কম বিপর্যয়কর হবে না। যে ‘বিপর্যয়ের’ রাজনৈতিক আওতার বাইরে নেই বাংলাদেশিরাও—যাঁরা এখন দুর্ভিক্ষ বনাম সুষ্ঠু নির্বাচনের দোলাচলে আছেন!
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক