লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ওপর আবারও হামলা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। গতকাল শুক্রবারের এ হামলায় দুই শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। এ নিয়ে টানা তিন দিন শান্তিরক্ষীদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার ঘটনা ঘটল। শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কেন্দ্রস্থলে ইসরায়েলের দুই দফা বিমান হামলায় ২২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। লেবাননের সরকার এ কথা জানিয়েছে। লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ নেতা ওফিক সাফাকে লক্ষ্য করে এ হামলা চালানো হয়েছিল। তবে হামলা থেকে বেঁচে যান তিনি। তিনটি সূত্র এ কথা জানিয়েছে।
ইসরায়েল সীমান্তবর্তী লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে জাতিসংঘ শান্তি মিশন ইউনিফিলের অধীন এক হাজারের বেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েন রয়েছেন। ব্যাপক বিমান হামলার পাশাপাশি বর্তমানে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে স্থল অভিযানও চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী।
গতকাল নাকোরা এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন ইউনিফিলের মূল ঘাঁটির একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে ট্যাংক থেকে গোলাবর্ষণ করে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে দুই শান্তিরক্ষী আহত হন। আগের দিন একই ঘাঁটির পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে গোলাবর্ষণ করলে টাওয়ারটি ধসে পড়ে। এতে দুই শান্তিরক্ষী আহত হন।
আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গতকালের হামলায় শ্রীলঙ্কার কয়েকজন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন। আগের দিনের হামলায় ইন্দোনেশিয়ার দুই শান্তিরক্ষী আহত হন।
শান্তরক্ষীদের ওপর হামলার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি ইসরায়েল সরকার। তবে জাতিসংঘে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত ড্যানি ড্যানন গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে বলেছেন, লড়াই তীব্রতর হওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে ইউনিফিল মিশন আরও পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে সরিয়ে নেওয়া হোক।
শান্তিরক্ষীদের ওপর গোলাবর্ষণ ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি হামলার ঘটনাকে আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে আহ্বান জানিয়েছেন গুতেরেস।
শান্তিরক্ষীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন জাতিসংঘের মহাসচিব। একই সঙ্গে তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে উসকানির সুযোগ দিতে পারে না বিশ্ব। এটিকে বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার খবরে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। হামলার বিষয়ে ইসরায়েলের কাছে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে ওয়াশিংটন। এদিকে গতকাল লাওসে অনুষ্ঠিত পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন লেবাননে কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো যাবে এবং বৃহৎ পরিসরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া ঠেকানো যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘এই অঞ্চলে বৃহত্তর সংঘাত প্রতিরোধে আমরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছি।’
শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলা করায় ইসরায়েলের কড়া সমালোচনা করেছেন ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী গুইদো ক্রসেত্তো। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘এটি ভুলবশত ঘটেনি এবং এটি কোনো দুর্ঘটনা ছিল না।’ ইতালির প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, এটি যুদ্ধাপরাধের শামিল হতে পারে এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের বিষয়টিই তুলে ধরেছে।
এদিকে শান্তিরক্ষীদের ওপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ এবং এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে চীনও। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেন, ইউনিফিলের অবস্থানে ও পর্যবেক্ষণ পোস্টগুলোতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর হামলার ঘটনায় চীন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বৈরুতের মধ্যাঞ্চলে দুই দফা ইসরায়েলি বিমান হামলায় ২২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ১১৭ জন। লেবাননের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব তথ্য জানিয়েছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে প্রচারিত ভিডিওতে বৈরুতের রাস এল নাবা ও আল নুয়েইরি এলাকায় বিমান হামলার পর বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি দেখা গেছে।
আগে থেকে কোনো ধরনের সতর্কবার্তা ছাড়াই এসব হামলা চালানো হয়েছে। এতে বৈরুতের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ইসরায়েলি হামলার মুখে অনেকেই দক্ষিণাঞ্চল থেকে সরে গিয়ে রাজধানী বৈরুতে আশ্রয় নিয়েছেন।
গত সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে এ পর্যন্ত তৃতীয়বারের মতো বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরতলি দাহিয়ের বাইরে ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দাহিয়েতে প্রায় প্রতিদিনই বিমান হামলা হতে দেখা গেছে।
এদিকে ইসরায়েলে পাল্টা হামলা চালানো অব্যাহত রেখেছে হিজবুল্লাহ। দেশটির উত্তরাঞ্চলের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ শহর হাইফা লক্ষ্য করেও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালানোর দাবি করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। লেবাননের পাশাপাশি ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায়ও হামলা জোরদার করেছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় গতকাল জানিয়েছে, গাজায় ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় আরও ৬১ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ২৩১ জন। এ নিয়ে গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ৪২ হাজার ১২৬ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।