বৈরী সময়ে যুক্তরাজ্যে তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী

লিজ ট্রাস
ছবি: রয়টার্স

ছয় বছরের মধ্যে যুক্তরাজ্যের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ক্ষমতাসীন দল কনজারভেটিভ পার্টি লিজ ট্রাসকে নেতা নির্বাচন করেছে, যিনি হবেন দেশটির তৃতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী। নারী নেতৃত্ব নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টি এক অনন্য রেকর্ড তৈরি করল, যা লেবার পার্টি এখনো পারেনি।

লিজ ট্রাসের প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাক নির্বাচিত হলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে সেটিও হতো এক নতুন রেকর্ড। সব ঠিক থাকলে আজ মঙ্গলবার লিজ ট্রাস প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেবেন।

ইউক্রেনে রুশ অভিযানের কারণে সৃষ্ট জ্বালানিসংকটে ইউরোপ ও বাকি বিশ্বজুড়ে যে অভাবনীয় অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তার পটভূমিতে কনজারভেটিভ পার্টির নতুন নেতা হিসেবে লিজ ট্রাস যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন, তার কোনো আশু সমাধান দেওয়া সম্ভব কি না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

সোজা কথায় যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সংকট মোকাবিলা‍য় কার্যকর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেওয়াই হবে তাঁর প্রধান ও প্রথম কাজ। মূল্যস্ফীতির হার ইতিমধ্যেই ১০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, জ্বালানির দাম দ্বিগুণ হয়েছে এবং তা আরও বহুগুণ বাড়ার পূর্বাভাস রয়েছে। রেলশ্রমিক, ডাক বিভাগের কর্মী ও ব্যারিস্টাররাও দফায় দফায় ধর্মঘট করছেন। নার্স ও সরকারি কর্মচারীরাও ধর্মঘটের হুমকি দিয়েছেন। ফলে মজুরি বাড়ানো ও আর্থিক সহায়তা বাড়ানোর চাপ বাড়ছে। যুক্তরাজ্যে সত্তরের দশকের মতো আরেকটি গভীর মন্দার মুখে পড়তে যাচ্ছে বলে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড সতর্কবাণী দিয়ে রেখেছে, তার স্থায়িত্ব ও গভীরতায় রাশ টেনে ধরাই হবে নতুন প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

নির্বাচনী প্রচারের সময়ে লিজ ট্রাস যেসব কর্মসূচি ও নীতির কথা ঘোষণা করেছেন, তার কেন্দ্রে আছে অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য ব্যবসাবান্ধব কর কমানোর অঙ্গীকার। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাক ও শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদেরা বৃহৎ ব্যবসার জন্য কর কমানোর বদলে সাধারণ মানুষের জন্য নগদসহায়তা জরুরি বলে মত দিয়েছিলেন। তবে লিজ ট্রাস তাঁর কর কমানোর নীতিতে অনড় ছিলেন। বিজয়ী ঘোষিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম বক্তৃতায় তিনি কর কমানোর মাধ্যমে অর্থনীতির সম্প্রসারণ, জ্বালানিসংকট মোকাবিলার পদক্ষেপ এবং জাতীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থার সমস্যা মোকাবিলায় অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলেছেন।

গতকাল সোমবার ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, দলের ১ লাখ ৭২ হাজার ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন ৮২ শতাংশ। লিজ ট্রাসের পাওয়া ভোটের হার ৫৭ শতাংশের মতো, যা তাঁর পূর্বসূরি বরিস জনসনের চেয়ে অনেক কম। বস্তুত তাঁর পূর্বসূরি তিনজনের প্রত্যেকেই ৬০ শতাংশের ওপর ভোট পেয়েছিলেন। বরিস জনসন ৬৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ায় কনজারভেটিভ পার্টির নীতি ও গতিপথ নির্ধারণে যথেষ্ট কর্তৃত্বের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। লিজ ট্রাস দলে ততটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম না–ও হতে পারেন বলে পর্যবেক্ষকদের ধারণা। কারণ, হিসেবে রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসে ধারাবাহিকতা না থাকার কথাও অনেকে বলে থাকেন।

লিজ ট্রাস কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগদানের আগে লিবারেল ডেমোক্র্যাটস পার্টির সদস্য ছিলেন। তবে কনজারভেটিভ পার্টিতে তাঁর উত্থান ঘটে বেশ দ্রুত। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে ব্রেক্সিট গণভোটে তিনি ইউনিয়নে থাকার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তাঁর অবস্থান ভুল ছিল স্বীকার করে কট্টর ব্রেক্সিট সমর্থকে পরিণত হন। নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবার শেষে নামলেও তিনি নিজেকে রক্ষণশীল ব্রিটিশদের আদর্শ মার্গারেট থ্যাচারের প্রতিভূ হিসেবে তুলে ধরে ডানপন্থী নীতিগুলোর ওপর জোর দেন। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রীয় অনুদান দেওয়ার নীতির বিরোধী হলেও প্রচারপর্বের শেষ দিকে তিনি তাঁর অবস্থান কিছুটা বদলে আশু সহযোগিতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিয়েছেন।

পররাষ্ট্রনীতিতে লিজ ট্রাসকে আশু যে সমস্যা মোকাবিলা করতে হবে, তা হলো ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখা এবং রাশিয়ার বিভিন্ন কৌশল মোকাবিলা করা। পুতিন প্রশাসনের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে লিজ ট্রাসের সম্পর্ক ছিল খুবই অস্বস্তিকর ও বৈরী। ব্রেক্সিট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে তাঁর মতপার্থক্য ও দূরত্ব বেশ প্রকট। নির্বাচনী প্রচারের সময় ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সম্পর্কে তাঁর কূটনীতিবর্জিত মন্তব্য নতুন অস্বস্তির জন্ম দিয়েছে। ইউরোপের সঙ্গে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে উত্তর আয়ারল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের মধ্যে শুল্ক আদায়ের ব্যবস্থা নিয়ে যে বিরোধ, তা-ও নতুন সমস্যার কারণ হতে পারে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সময়ে যেসব নীতি গৃহীত হয়েছিল, সেগুলোতে কোনো ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। বিশেষত বৈদেশিক সহায়তার আলাদা মন্ত্রণালয়কে তাঁর সময়েই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ফিরিয়ে আনা হয়েছে এবং সহায়তার পরিমাণও কমানো হয়েছে। ফলে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কে বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। বাণিজ্যেও বাংলাদেশের রপ্তানির শুল্কমুক্ত–সুবিধা বহাল থাকার নীতি অব্যাহত থাকবে বলেই ধরে নেওয়া যায়।

অর্থনীতির মতোই যুক্তরাজ্যের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও লিজ ট্রাসের সামনের দিনগুলো মোটেও মসৃণ হবে না। তিনি স্কটল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রী নিকোলা স্টারজেনকে কটাক্ষ করে ইতিমধ্যেই কিছুটা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের দাবি মোকাবিলায় তাঁর কৌশল কী হবে, সেটিও দেখার বিষয়। ৬ জুলাই বরিস জনসন বিদায় নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর টানা দুই মাস ধরে চলা প্রচারপর্ব দল ও সরকার পরিচালনার দুর্বলতাগুলো জনসমক্ষে খোলাসা করে দিয়েছে।

একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিয়ে সরকার ও রাজনীতির প্রতি আস্থার সংকট তৈরির পর বরিস জনসন দলীয় এমপিদের আস্থা হারিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন। ফলে বরিসের সমর্থক হিসেবে লিজ ট্রাস ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়েন। একপর্যায়ে বিতর্কের জেরে দলের শীর্ষনেতারা প্রকাশ্যেই তাঁদের অস্বস্তি প্রকাশ করতে থাকেন। বন্ধ হয়ে যায় টেলিভিশন বিতর্ক। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এই নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা কার্যত আশীর্বাদ হয়ে ওঠে।

জনমত জরিপ বলছে, যুক্তরাজ্যের মানুষ কনজারভেটিভ পার্টির টানা ১২ বছরের শাসনে কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছে। ৮২ শতাংশ মানুষ অচিরেই একটি সাধারণ নির্বাচন চায়। এমনিতে নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৪ সালে।

কিন্তু লিজ ট্রাস সে পর্যন্ত নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, তা-ও একট বড় প্রশ্ন। দলটির সমর্থক পত্রিকা টেলিগ্রাফ বলছে, দলটির নেতাদের বড় অংশ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। আর বরিস–ভক্তদের অনেকেই ভাবছেন, লিজ ট্রাস সংকট সামাল দিতে না পারলে তাঁর ফিরে আসার পথ খুলে যাবে।