ইউক্রেন ১৬ হাজারের বেশি শিশুকে জোর করে রাশিয়ায় স্থানান্তরের অভিযোগ করেছে।
ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে বিচারের সম্মুখীন হওয়ার নজির আছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসন পরিচালনার পর থেকে ইউক্রেনীয় শিশুদের অপহরণ ও বেআইনিভাবে তাদের দেশান্তর করার জন্য পুতিনের ওপর যুদ্ধাপরাধের দায় বর্তায় বলে মনে করেন আদালত। একই অভিযোগে রাশিয়ার শিশুবিষয়ক কমিশনার মারিয়া আলেক্সিয়েভনা এলভোভা-বেলোভার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
রাশিয়া বলেছে, তারা যেহেতু নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে অবস্থিত আইসিসির এখতিয়ার স্বীকার করে না, তাই এ আদেশের কোনো গুরুত্বই নেই।
আইসিসির প্রাক্–বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা গতকাল শুক্রবার এ পরোয়ানা জারি করেছেন। আইসিসির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আদালত প্রথমে গোপনে পরোয়ানা জারির কথা বিবেচনা করলেও শেষ পর্যন্ত তা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যাতে তা আরও অপরাধ সংঘটন নিবৃত্ত করায় ভূমিকা রাখতে পারে। অপরাধের শিকার ভুক্তভোগী ও সাক্ষীদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনেই পরোয়ানা গোপন রাখার কথা ভাবা হয়েছিল বলে বিবৃতিতে জানানো হয়।
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি করিম খান এক বছর আগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রুশ টেলিভিশনে প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে দেশটির শিশুবিষয়ক কমিশনার এলভোভা–বেলোভা ইউক্রেনীয় শিশুদের দেশান্তর করার পর রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে কীভাবে তাদের দত্তক নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে, তা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন। ওই টেলিভিশন সম্প্রচারের পরই সম্ভবত আইসিসির কৌঁসুলি তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেন বলে মনে করা হচ্ছে।
এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় শিশুদের ক্ষেত্রে যুদ্ধাপরাধ ঘটেছে বলে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ইউক্রেন ১৬ হাজারের বেশি শিশুকে জোর করে রাশিয়ায় স্থানান্তরের অভিযোগ করেছে। ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের আরও অনেক অভিযোগ থাকলেও শিশুদের জোর করে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার ঘটনাকেই আপাতত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের জন্য বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে।
আইসিসির পরোয়ানা জারির প্রতিক্রিয়ায় রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেছেন, আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁদের দেশের জন্য আইসিসির সিদ্ধান্তের কোনো মানে নেই। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতবিষয়ক রোম সনদে অংশ নেয়নি এবং এর কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করে না। রাশিয়া ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহযোগিতা করে না এবং তাদের কাছ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত এলে তা আমাদের জন্য আইনগতভাবে বাতিল বলে গণ্য হবে।’
এ পরোয়ানার কারণে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধে আশু কোনো প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পদস্থ রুশ জেনারেলরা ভবিষ্যতে আইসিসির সম্ভাব্য বিচারের সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কায় যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে আসবেন বা যুদ্ধের নৃশংসতা কমবে—এমন সম্ভাবনা আদৌ আছে কি না, তা নির্ভর করবে দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। পুতিনবিরোধী রাজনৈতিক শক্তির সে রকম কোনো অবস্থান এখনো দেখা যাচ্ছে না। এ পরোয়ানার কারণে পুতিন এখন বিশ্বে কতটা নিঃসঙ্গ বা অচ্ছুত হয়ে পড়বেন, তা–ও স্পষ্ট নয়। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আগামী সোমবারই মস্কোতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার কথা আছে। তবে ভবিষ্যতে মস্কোয় ক্ষমতার পালাবদল হলে তাঁকে আইসিসির কাছে হস্তান্তরের ঝুঁকি তাঁর সামনে থাকছেই।
যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার ক্ষেত্রে আইসিসি কোনো সরকারপ্রধানকে দায়মুক্তি দেন না। তবে রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তির প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এসব অপরাধের বিচারের জন্য ১৯৯৮ সালের ১৭ জুলাই জাতিসংঘের আয়োজনে এক সম্মেলনে ওই সনদ গৃহীত হয় এবং তা প্রয়োজনীয়সংখ্যক দেশের অনুসমর্থনের পর ২০০২ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।
আইসিসির রোম সনদে শুধু রাশিয়া নয়; যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ বেশ কয়েকটি বৃহৎ ও উদীয়মান শক্তি অনুসমর্থন দেয়নি। ফলে এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করা কার্যত অসম্ভব। সনদের বিধান অনুসারে সদস্যদেশগুলো আদালতের অনুরোধ ও আদেশ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করার জন্য দায়বদ্ধ। কেননা, আইসিসি কিংবা জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো বাহিনী নেই, যারা ওই আদেশ প্রতিপালন করবে। আইসিসির আদেশের পরিণতিতে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পাশ্চাত্যের কোনো দেশে ভ্রমণ হয়তো সম্ভব হবে না।
কোনো দেশের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ২০০৯ সালের ৪ মার্চ সুদানের সাবেক শাসক ওমর আল বশিরের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রাক্–বিচারিক ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিলেন। সুদানও আইসিসির রোম সনদে স্বাক্ষরকারী নয়। তবে সনদে স্বাক্ষরকারী না হলেও যেকোনো দেশের সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে আইসিসি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরোয়ানা জারি কিংবা বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। ২০০৫ সালে সুদানের বিরুদ্ধে দারফুরে গণহত্যার অভিযোগ তদন্তের জন্য আইসিসিকে অনুরোধ জানায় নিরাপত্তা পরিষদ। তবে আফ্রিকান ইউনিয়ন ও আরব লিগ ওই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সমর্থন করেনি। ফলে আফ্রিকার একাধিক দেশ আইসিসির পরোয়ানা কার্যকর করেনি এবং সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট কয়েকটি দেশে নির্বিঘ্ন সফর করেছেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সুদানে গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন এবং ২০২০ সালে দেশটির সরকার তাঁকে আইসিসিতে বিচারের জন্য পাঠাতে রাজি হয়।