প্রাচীন গ্রিস কিংবা রোমের যোদ্ধাদের নিয়ে আমরা অনেক কিছু জানতে পারি। রাজা–আমত্যদের বিলাসবহুল জীবনের গল্প জানার বিস্তর সুযোগ আছে আমাদের। কিন্তু কেমন ছিলেন প্রাচীন ইউরোপ তথা গ্রিস ও রোমের নারীরা? বিশেষ করে তাঁদের যৌনজীবন কেমন ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর জানার সুযোগ খুবই সীমিত।
যতটুকু জানা যায়, বেশির ভাগই পুরুষ কবি, সাহিত্যিক, চিত্রকরদের বয়ান। অনেকেই বলেন, এগুলো অতিরঞ্জিত। হয় নারীদের চরিত্রকে ‘অতি ভালো’ চিহ্নিত করা হয়েছে; নয়তো ‘খুবই খারাপ’। নারীদের প্রকৃত আবেগ, অভিব্যক্তি ও ভাবনাকে সঠিকভাবে খুব কমই তুলে ধরা হয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নাম ‘দি মিসিং থ্রেডস: আ নিউ হিস্ট্রি অব দ্য অ্যানশিয়েন্ট ওয়ার্ল্ড থ্রু দ্য ওমেন হু শেপড ইট’। লিখেছেন ডেইজি ডুন। আগামী জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রেও বইটি প্রকাশিত হবে। এ বইয়ে ডেইজি প্রাচীন ইউরোপের নারীদের যৌনজীবন নিয়ে পুরুষতান্ত্রিক বয়ানের বাইরে নির্মোহ উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন।
ডেইজির লেখা বইয়ে উল্লেখ আছে সেমোনিদেস অব আমোরগোসের কথা। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকের গ্রিক কবি তিনি। এ কবি লিখেছিলেন, তখনকার গ্রিসে নারীদের ১০টি ধরন ছিল। যেমন শুকরের মতো নারী। তাঁরা পরিচ্ছন্নতার চেয়ে খাওয়াদাওয়া বেশি পছন্দ করতেন। ছিলেন শেয়ালের মতো নারী। তাঁদের পর্যবেক্ষণক্ষমতা ছিল শেয়ালের মতোই তীক্ষ্ণ।
গাধার মতো নারী: তাঁরা ছিলেন বেশ যৌনতাপূর্ণ। নিজেদের অবাধ্যতার জন্য পরিচিত ছিলেন কুকুরের মতো নারীরা। আরও ছিলেন ঝোড়ো সাগরের মতো নারী, ক্ষুধিত পৃথিবীর মতো নারী, চোরা বেজির মতো নারী, অলস ঘোড়ার মতো নারী, বানরের মতো অনাকর্ষণীয় নারী।
সবচেয়ে ভালো মৌমাছির মতো নারীর কথা বলেছেন সেমোনিদেস। এসব নারী কঠোর পরিশ্রমী। তবে এ কবির মতে, যৌনতায় সবচেয়ে রহস্যময়ী ছিলেন গাধার মতো নারীরা।
ঐতিহাসিকদের বয়ানে দেখা যায়, প্রাচীন গ্রিসের নারীরা জনসম্মুখে সাধারণত পর্দা মেনে চলতেন। রোমান নারীদের চলাফেরা ও সম্পত্তি দেখভালে ভূমিকা রাখতেন পুরুষ অভিভাবক, বিশেষ করে বাবা ও স্বামী। তবে ধারণা করা হয় যে প্রাচীন ইউরোপের নারীরা বেশ আবেদনময়ী ছিলেন। যৌনজীবনের ব্যাপারে তাঁদের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। তবে অনেকেই বলেন, এটা নিছক পুরুষের অতিরঞ্জিত কল্পনার প্রকাশ।
ডেইজি বলেন, তিনি তাঁর বইটি লেখার আগে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছেন, প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাস প্রথম নারীদের হাতে লেখা হয়েছিল। তাই ওই সময়ের নারীরা যৌনতা নিয়ে কী ভাবতেন, তা উদ্ঘাটন করতে হলে আমাদের কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, ওই সময়ের তথ্য–উপাত্তের যে ভান্ডার আমরা পাই, তাঁর বেশির ভাগ পুরুষের লেখা। এর বেশির ভাগই পক্ষপাতদুষ্ট। তাঁরা সেই সময়কার নারীদের হয় ‘যৌনতাকাতর’ কিংবা ‘অতি ভালো’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে সৌভাগ্যবশত তখনকার কিছু লেখকের কাজে নজর দেওয়া সম্ভব, যাঁরা নারীর যৌনতা সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিপাত রেখে গেছেন।
সেমোনিদেস যখন প্রাচীন ইউরোপীয় নারীদের ১০টি ধরনের কথা লিখেছেন, সমসাময়িক সময়ে সাপ্পোহ নারীর কোমল হৃদয়ের কথা তাঁর কবিতায় তুলে এনেছেন। খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকে গ্রিসে গীতিকবিতা লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি।
এই কবির লেখায় উঠে এসেছে একজন পুরুষের সঙ্গে আলাপরত এক নারীর মনের গভীর কোমল অনুভূতির কথা। হৃদয়ের স্পন্দন, শিরা দিয়ে আগুনের হল্কা বয়ে যাওয়া, চোখ ঝাপসা হয়ে আসা, ঘামের শীতল স্রোত বয়ে যাওয়া, ফ্যাকাসে হয়ে ওঠা ইত্যাদি নানা উপমা ব্যবহার করেছেন তিনি। প্রিয় মানুষের সংস্পর্শে এমন অনুভূতি আমাদের অচেনা নয়।
আরেকটি গীতিকবিতায় কবি ফুলের মালা গলায় পরা এক নারীর বয়ানে ‘প্রিয় মানুষের সঙ্গে নরম বিছানায় আকাঙ্ক্ষা পূরণের’ প্রেমময় বিবরণ তুলে ধরেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে ওই সময়ের নারীরা তাঁদের মোহের বিষয়ে অদম্য ও বেশ সাবলীল ছিলেন।
প্রাচীন ইউরোপীয় যৌনকর্মীদের জীবন বুঝতে হলে পম্পেই নগরীর পতিতালয়ে ঢুঁ দিতে হবে। সেখানে যৌনতা ছিল অবাধ। ছোট ছোট সেলে থাকতেন যৌনকর্মীরা। সেগুলোর দেয়ালে দেয়ালে আঁকা হতো নানা গ্রাফিতি। আর তা থেকে যৌনকর্মীদের জীবন–যৌনতা সম্পর্কে আঁচ করা যায়।
সময়টা তখন খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক। এথেনীয় রাজনীতিক অ্যাপোলোদোরাস দারুণ একটি বক্তব্য দিয়েছিলেন। তাতে যৌনকর্মীদের জীবনের আবেগ ও কষ্টের মর্মস্পর্শী বয়ান ফুটে উঠেছিল।
খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে নোসিস নামের এক ইতালীয় নারী কবি একটি চিত্রকর্মের ভূয়সী প্রশংসা করে স্তুতি লিখেছিলেন। তিনি লেখেন, ওই চিত্রকর্ম একজন যৌনকর্মীর অর্থায়নে আঁকা। এ ছাড়া তাঁদের অর্থায়নে নির্মিত আফ্রোদিতির (গ্রিসের প্রেম ও যৌনতার দেবী) একটি ভাস্কর্য মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছিল।
লেসিসত্রাতা—গ্রিক কমেডিয়ান অ্যারিস্টোফানেস রচিত একটি নাটক। খ্রিষ্টপূর্ব ৪১১ সালে এটা লিখেছেন তিনি। এতে এথেন্সের নারীদের ‘যৌন ধর্মঘটের’ চিত্রায়ন করা হয়েছে। ওই সময় প্রায় তিন দশক ধরে এথেন্স আর স্পার্টার মধ্যে ‘পেলোপোনেশিয়ান যুদ্ধ’ চলছিল। এথেন্সের নারীরা তাঁদের যোদ্ধা স্বামীদের শান্তির শর্তে রাজি করানোর জন্য ‘যৌন ধর্মঘট’ (যৌনমিলন থেকে বিরত থাকা) তথা ‘কার্যত কঠিন’ কৌশল বেছে নিয়েছিলেন। নাটকে এটাই তুলে ধরা হয়েছে।
নাটকের মূল চরিত্র লেসিসত্রাতা নারীদের নিয়ে এই ‘যৌন ধর্মঘট’ শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এটা বিবাহিত নারীদের জীবনকে নরকে পরিণত করেছে। আর অবিবাহিতদের জন্য নিদারুণ কষ্ট বয়ে এনেছে। কেননা, তাঁদের অনেকেই বিয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু বৃহত্তর শান্তি স্থাপনে এটা কার্যকর কৌশল ছিল।
লেসিসত্রাতা আরও বলেন, পুরুষেরা ধূসর চুল নিয়ে যুদ্ধ থেকে ফিরে আসতে পারেন। ফিরে বিয়েও করতে পারেন। কিন্তু নারীরা সেটা পারেন না। কেননা, তখন কুমারী নারীদের অনেককেই বিয়ে ও সন্তান জন্মদানের জন্য বেশি বয়সী হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
এসব বাক্য যুদ্ধকালে পুরুষ ও নারীদের মনোভাবের স্বাতন্ত্র্য, অভিজ্ঞতার পার্থক্য নিখুঁতভাবে প্রকাশ করেছে। ওই সময়ের নারীরা যা বলেছেন, তা আসলেই বাস্তবিক, এমন বিশ্বাস তৈরির চেষ্টা আছে এসব বাক্যে।
প্রাচীন ইউরোপীয় নারীরা যৌনতা নিয়ে নানা পরামর্শ (টিপস) প্যাপিরাসে লিখেছেন। গ্রিসের নারী দার্শনিক থিয়ানোর (তিনি পিথাগোরাসের সার্কেলের দার্শনিক ছিলেন। কেউ কেউ বলেন, তিনি ছিলেন পিথাগোরাসের স্ত্রী) লেখা একটি চিঠির কথা বলা যায়। বন্ধু ইউরিডাইসকে পরামর্শ দিয়ে চিঠিটি লিখেছিলেন তিনি। বন্ধুকে থিয়ানোর পরামর্শ, তিনি যখন স্বামীর সঙ্গে বিছানায় যাবেন, তখন তাঁর পোশাক ও লজ্জা দুটোই ত্যাগ করা উচিত। আর বিছানা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটোই ফিরিয়ে আনতে হবে।
থিয়ানোর লেখা এ চিঠি নিয়ে মতভেদ আছে। বহু যাচাই–বাছাই হয়েছে। অনেকের মতে, এ চিঠি থিয়ানো না–ও লিখে থাকতে পারেন। তবে এটা বলা যায় যে আধুনিক বিশ্বে নারীরা যেমন একে অন্যকে নানা রকম পরামর্শ দেন, প্রাচীন সমাজের নারীরাও তেমনটা করতেন। বিশেষ করে যৌনতা নিয়ে।
প্রাচীন গ্রিক কবি এলিফ্যান্টিস নারীদের যৌনতাসংক্রান্ত পরামর্শ দিতে এতটাই উদগ্রীব ছিলেন যে এসব নিয়ে একটি পুস্তিকা লিখেছিলেন তিনি। তবে দুর্ভাগ্য, তাঁর লেখার অস্তিত্ব আজ আর নেই। তবে এলিফ্যান্টিস আর যৌনতা নিয়ে তাঁর পরামর্শের কথা রোমান কবি মার্শাল ও রোমের জীবনীকার শুয়েন্তোনিয়াসের লেখায় উঠে এসেছে। বলা হয়, এলিফ্যান্টিসের লেখা রোমান সম্রাট তিবেরিয়াসের (নিজের যৌনতার জন্য কুখ্যাত ছিলেন) সংগ্রহে ছিল।