পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার হাতে এখন বড় অস্ত্র জ্বালানি। দেশটির প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের নির্ভরশীলতা রয়েছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে ইউরোপ যখন মস্কোর ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে, তখন রাশিয়ার পাল্টা জবাব আসছে গ্যাসের মাধ্যমে।
সর্বশেষ শনিবার লাটভিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করেছে রাশিয়ার রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত জ্বালানি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম। শর্ত ভঙ্গের জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গ্যাসের জন্য মূলত রাশিয়ার ওপরই নির্ভর করে লাটভিয়া।
গ্যাস নিয়ে পশ্চিমা দেশ ও রাশিয়ার যুদ্ধ কিন্তু একেবারে নতুন নয়। এ দ্বন্দ্বের শুরুটা কবে, আর কীভাবে তা দিন দিন গভীর হয়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে।
চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে অভিযান শুরু করে রাশিয়া। এর আগে ২২ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে মস্কোপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় ক্রেমলিন। জবাবে নর্ড স্ট্রিম–২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প স্থগিত করেন জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ।
এ প্রকল্পের মাধ্যমে জার্মানিতে বাড়তি গ্যাস সরবরাহের কথা ছিল রাশিয়ার। তবে নর্ড স্ট্রিম–২ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বার্লিনের মিত্রদের দুশ্চিন্তার কমতি ছিল না। তাদের শঙ্কা ছিল, প্রকল্পটি চালু হলে রাশিয়ার ওপর জার্মানির জ্বালানি নির্ভরশীলতা আরও বাড়বে। নর্ড স্ট্রিম-২–এর কারণে রাজস্ব হারানোর ভয় ছিল ইউক্রেনেরও।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরু থেকেই শঙ্কা ছিল ইউরোপের দেশগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারে রাশিয়া। এর জেরে বাড়তে শুরু করে জ্বালানিটির দাম। পরে ২ মার্চ আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট থেকে রাশিয়ার সাতটি ব্যাংককে বাদ দেয় ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
তবে জ্বালানি খাতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক থাকা বড় দুই ঋণদাতাকে ইইউর এ সিদ্ধান্তের বাইরে রাখা হয়েছিল। দুই ঋণদাতাকে ছাড় দেওয়ার এ পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর ইইউর কয়েকটি দেশের নির্ভরশীলতাই ফুটে উঠেছিল।
গত ৮ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশটিতে রাশিয়ার গ্যাস ও জ্বালানি তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঘোষণা দেয়, তারা ২০২২ সালের মধ্যে রাশিয়া থেকে গ্যাস আমদানি দুই–তৃতীয়াংশ কমাবে। আর যুক্তরাজ্য চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার জ্বালানি আমদানি পুরোপুরি বন্ধের কথা বলেছে।
বিভিন্ন দেশে রাশিয়ার ৩০ হাজার কোটি ডলার রিজার্ভ আটকে দেওয়ার জবাবে গত ২৩ মার্চ দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা দেন, ইউরোপের দেশগুলো ডলার বা ইউরো দিয়ে রাশিয়ার গ্যাস কিনতে পারবে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশসহ ‘অবন্ধুসুলভ’ রাষ্ট্রগুলোকে গ্যাসের দাম দিতে হবে রুশ মুদ্রা রুবলে।
তবে এ নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে সতর্ক করে ইউরোপীয় কমিশন। বলা হয়, তারা যদি গ্যাসের দাম রুবলে পরিশোধ করে, তা হবে মস্কোর ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার লঙ্ঘন। এরই মধ্যে চলতি বছর ইউরোপের দেশগুলোকে অতিরিক্ত ১৫ হাজার কোটি ঘনমিটার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহে রাজি হয়েছে ওয়াশিংটন।
গত ২৭ এপ্রিল বুলগেরিয়া ও পোল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে গাজপ্রম। রাশিয়ার এ পদক্ষেপকে ‘ব্ল্যাকমেল’ বলে আখ্যা দেন ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ভন ডার লিয়েন। তবে আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এ দুই দেশ এখন প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে গ্যাস পাচ্ছে।
পরে ২১ মে ফিনল্যান্ডে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে রাশিয়া। দেশটি রাশিয়াকে রুবলে গ্যাসের দাম পরিশোধে নারাজ ছিল। এ ছাড়া ন্যাটোতে যোগ দিতে চাওয়ায় ফিনল্যান্ডের ওপর চটে ছিল মস্কো। রুবলে দাম দিতে না চাওয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয় নেদারল্যান্ডস ও ডেনমার্কেও।
চলতি বছরের শেষ নাগাদ রাশিয়ার বেশির ভাগ জ্বালানি তেল আমদানি বন্ধে গত ৩০ মে ঐকমত্যে আসেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা। তবে দেশটির গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া থেকে বিরত থাকেন তাঁরা।
জুনের মাঝামাঝি জার্মানিতে প্রতিদিনের গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয় গাজপ্রম। তখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপ্রার্থী হিসেবে ইউক্রেনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথে ছিলেন জোটটির নেতারা। গ্যাস সরবরাহ কমানোর কারণ হিসেবে বলা হয় কারিগরি ত্রুটির কথা।
১১ জুলাই থেকে ১০ দিন নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলে। ওই সময় ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ছিল। এর এক সপ্তাহ পর জ্বালানিসমৃদ্ধ কাস্পিয়ান দেশগুলো থেকে গ্যাস আমদানি দ্বিগুণ করতে চুক্তি করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আজারবাইজান।
জ্বালানি ঘাটতি পূরণে কাতার, নরওয়ে ও আলজেরিয়ার দ্বারস্থও হয় ২৭ দেশের এ জোট। ২০ জুলাই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে গ্যাসের চাহিদা ১৫ শতাংশ কমানোর আহ্বান জানায় ইউরোপীয় কমিশন। উদ্দেশ্য শীতকালের জন্য যথেষ্ট জ্বালানি মজুতের বিষয়টি নিশ্চিত করা।
২৫ জুলাই গাজপ্রম জানায়, তারা নর্ড স্ট্রিম পাইপলাইনের সক্ষমতার ২০ শতাংশ কম গ্যাস সরবরাহ করবে। কারণ হিসেবে দেখানো হয় পাইপলাইনের একটি টারবাইনের ‘কারিগরি অবস্থা’। তবে প্রতিষ্ঠানটির ‘অজুহাত’ অযৌক্তিক বলে দাবি করে জার্মান সরকার। এরপর সর্বশেষ ৩০ জুলাই শনিবার লাটভিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হলো।