১ লাখ ৭৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। আয়তনের দিক দিয়ে বাংলাদেশের চেয়েও বড়। সেখানে পোঁতা অসংখ্য স্থলমাইন। বলা চলে পদে পদে মৃত্যু। বিশাল আয়তনের এই ভূখণ্ড রয়েছে ইউক্রেনজুড়ে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাদের ধরাশায়ী করতে মাইনগুলো পুঁতেছে রাশিয়া।
ইউক্রেনে স্থলমাইনের কথা বললে প্রথমেই আসে খারকিভ অঞ্চলের কথা। দেশটির যেকোনো অঞ্চলের চেয়ে সেখানে বেশি মাইন পাওয়া গেছে। এখন খারকিভে গেলে চোখে পড়বে ফেলে রাখা বিস্তীর্ণ জমি। কিছু দূর পরপর লেখা সতর্কবাণী, ‘বিপজ্জনক মাইন!’ এই জমিগুলোতে কেউ পা মাড়ান না।
যুদ্ধক্ষেত্রে বাটারফ্লাই মাইনের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। কারণ, সেগুলো নির্বিচার বেসামরিক লোকজনকে হতাহত করতে পারে।
খারকিভের অবস্থান ইউক্রেনের উত্তর-পূর্বে, রুশ সীমান্তের কাছে। গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরুর পরপরই অঞ্চলটির বড় অংশ দখল করে নেয় রুশ বাহিনী। পরে হামলার মুখে সেপ্টেম্বরে সেখান থেকে পিছু হটতে হয় তাদের। খারকিভে নিজেদের সুরক্ষা ও ইউক্রেনীয়দের অগ্রগতি ধীর করতেই মাইনগুলো পুঁতেছিল তারা।
এখন এই মাইনগুলো সরাতে কাজ করছেন অনেক ইউক্রেনীয়। যেমন ওলেকসান্দ্র রোমানেন্তের দল। খারকিভের বালাকলিয়া শহরে একটি আবাসিক ভবনের পাশের জমি থেকে ছয়টি মাইন খুঁজে বের করেছেন তাঁরা। এর আগে তাঁরা কাছাকাছি এলাকাগুলোতে আরও প্রায় ২০০টি মাইন পেয়েছেন।
মাইন সরানোর কাজ অতটাও সহজ নয়। রয়েছে ঝুঁকি। ওলেকসান্দ্র রোমানেন্তের দলের একজন গত বছর মাইন বিস্ফোরণে পা হারিয়েছেন। আরেক সদস্যও একইভাবে আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবার প্রতি সকালে আমাকে ফোন করে বলে, কাজ করার সময় আমি যেন দেখেশুনে পা ফেলি।’
ইউক্রেন সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর থেকে শুধু খারকিভেই মাইন বিস্ফোরণে ১২১ জন বেসামরিক মানুষ আহত হয়েছেন। নিহত হয়েছে ২৯ জন। আর এই সময়ে খারকিভে ৫৫ হাজারের বেশি মাইন খুঁজে পাওয়া গেছে। আর গোটা ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা শুরুর পর থেকে ৭২৪ জন মাইন বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২২৬ জন মারা গেছেন।
মাইনের আঘাতে আহত সেরহি বলেন, ‘আমি সুস্থ ছিলাম। দু্ই পায়েই হাঁটতে পারতাম, কাজকর্ম করতে পারতাম, গাড়ি চালাতে পারতাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার কোনো বাড়ি নেই, পা নেই।’
ওলেকসান্দ্র রোমানেন্তের মতো যাঁরা মাইন খোঁজার কাজ করছেন, তাঁদের ‘নায়ক’ খেতাব দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তাঁরা মূলত বাটারফ্লাই মাইন খোঁজার দিকে বেশি নজর দিচ্ছেন। খারকিভ এলাকায় এই মাইন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বাটারফ্লাই মাইনগুলো তিন থেকে চার ইঞ্চি চওড়া হয়। এগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয় রকেটের মাধ্যমে।
যুদ্ধক্ষেত্রে বাটারফ্লাই মাইনের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ। কারণ, সেগুলো নির্বিচার বেসামরিক লোকজনকে হতাহত করতে পারে। যেমন আহত হয়েছেন সেরহি নামে ইউক্রেনের এক বাসিন্দা। গাড়িতে মালামাল তুলতে এক বন্ধুকে সহায়তা করছিলেন তিনি। এ সময় অসাবধানতাবশত একটি গাছের দিকে পা বাড়ালে বিস্ফোরণে পেছনে ছিটকে পড়েন।
খারকিভের ইজিয়াম শহরের একটি হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সেরহি বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম গাড়ির একটি টায়ার হয়তো ফেটে গেছে। তারপর আমার পায়ের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার পায়ের আঙুলগুলো নেই। পায়ের নিচে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। রক্ত ঝরছিল।’
রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে সেরহির বাড়িও ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমি সুস্থ ছিলাম। দু্ই পায়েই হাঁটতে পারতাম, কাজকর্ম করতে পারতাম, গাড়ি চালাতে পারতাম। মুহূর্তের মধ্যে আমার কোনো বাড়ি নেই, পা নেই।’
ইজিয়ামের হাসপাতালে সেরহি যে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন, তাঁর নাম ইউরি কুজনেতসোভ। গত বছর খারকিভ যখন রাশিয়ার দখলে ছিল, তখন পুরো সময়টা রোগীদের চিকিৎসা করেছেন তিনি। এমনকি ইজিয়াম হাসপাতালে তিনি ছাড়া আর কোনো চিকিৎসক ছিলেন না।
সে সময় প্রতি সপ্তাহেই স্থলমাইনে আহত রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন ইউরি কুজনেতসোভ। তিনি বলেন, ‘এই বিস্ফোরকের (মাইন) কবলে পড়ে কোনো অঙ্গ হারানো বা আহত হওয়া সবচেয়ে খারাপ পরিণতি নয়। যেমন গত সপ্তাহে দুজন একটি মাইন দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁদের একজন এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন। অপরজন মারা গেছেন।’
খারকিভ অঞ্চলে ইজিয়াম ও এর আশপাশের এলাকায় সবচেয়ে বেশি মাইন পোঁতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, শুধু রুশ বাহিনীই নয়, ইউক্রেনের সেনারাও সেখানে মাইন পুঁতেছেন। বিষয়টি স্বীকার করে কিয়েভের দাবি, নিজেদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক আইন মেনেই এ কাজ করেছে তারা।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেনে পোঁতা সব মাইন সরিয়ে নিতে ৩৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। এ অর্থ জোগাড় করতে বিভিন্ন দেশের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টায় রয়েছে কিয়েভ। তাদের দাবি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ৭০ বছর ধরে ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে পোঁতা মাইন সরাচ্ছে তারা। তবে বর্তমানে এসে এই অর্থ জোগাড় করতে আশাবাদী হতে হবে তাদের।