৫০ বছর আগে যেভাবে ৮৪ ঘণ্টা পর উদ্ধার হয়েছিলেন সাবমেরিনের দুই নাবিক

৮৪ ঘণ্টা পর বিধ্বস্ত সাবমেরিন থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে নাবিক রজার চ্যাপম্যান ও রজার মালিনসন
ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া

৫০ বছর আগে আয়ারল্যান্ড থেকে ১৫০ মাইল দূরে সমুদ্রের ১ হাজার ৬০০ ফুট গভীরে একটি সাবমেরিন ডুবে গিয়েছিল। এতে আটকা পড়েছিলেন দুই ব্রিটিশ নাবিক। ছয় ফুট ব্যাসের একটি স্টিলের বলে তাঁরা আটকা পড়েছিলেন। কিন্তু শেষমেশ তাঁদের উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। এই দুই নাবিককে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁদের কাছে মাত্র ১২ মিনিট বেঁচে থাকার মতো অক্সিজেন অবশিষ্ট ছিল।

১৯৭৩ সালের ২৯ আগস্ট ওই সাবমেরিন ডুবে গিয়েছিল। সে সময় যুক্তরাজ্যের রাজকীয় নৌবাহিনীর সাবেক সাবমেরিনার রজার চ্যাপম্যানের বয়স ছিল ২৮ আর প্রকৌশলী রজার মালিনসনের বয়স ছিল ৩৫ বছর। একটি দুর্ঘটনায় আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে ওই সাবমেরিন বিধ্বস্ত হয়ে তলিয়ে যায়। দুই নাবিককে উদ্ধারে আন্তর্জাতিক উদ্ধার অভিযান চালানো হয়।

পাইলট রজার চ্যাপম্যান ও জ্যেষ্ঠ পাইলট রজার মালিনসন সাবমেরিনটি নিয়ে নিয়মিত কাজ করছিলেন। কানাডার বাণিজ্যিক এই সাবমেরিন ডাকব্যবস্থার জন্য সমুদ্রের তলদেশে ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিফোন কেব্‌ল বসাতে ভাড়ায় কাজ করছিল।
রজার মালিনসন বলেছিলেন, সমুদ্রের তলদেশে খুব বেশি দেখা যাচ্ছিল না। এটা কাজটিকে ক্লান্তিকর করে তুলেছিল। কোনো ঘুম ছাড়াই তিনি টানা ২৬ ঘণ্টা কাজ করেছিলেন।

কেব্‌ল স্থাপনের পাশাপাশি সাবমেরিনের পাইলটদের লাইফ সাপোর্ট দেখাশোনা করতে হতো। প্রতি ৪০ মিনিটে তাঁরা কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণের জন্য একটি লিথিয়াম হাইড্রোক্সাইড ফ্যান চালু করেন। এরপর অল্প পরিমাণে তাঁদের অক্সিজেন দেওয়া হয়। রেকর্ডের জন্য প্রতিবার ডাইভের সময় তাঁরা একটি ভিডিও ধারাভাষ্যও রেখেছিলেন।
চ্যাপম্যান বলেন, ‘আমাদের মূল জাহাজে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে টাওলাইন সংযুক্ত করতে অপেক্ষা করছিলাম। কাজের শেষ দিকে হঠাৎ পেছন দিকে বড় আঘাত লাগে এবং আমরা দ্রুত ডুবে যাই। আমরা উল্টো দিকে ঝুলে ছিলাম। যন্ত্রপাতি রাখার জায়গাটি প্লাবিত হয়ে যায়। হঠাৎ সাবমেরিনটি এক টনের বেশি ভারী হয়ে যায়। ভয় ছিল, আমরা হয়তো পিষ্ট হয়ে যাব।’

১৯৭৩ সালে বিধ্বস্ত সাবমেরিন উদ্ধারে অংশ নেওয়া সাবমেরিন ভাইকার্স

দুর্ঘটনার শুরুতেই এই দুই নাবিক সাবমেরিনের বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা বন্ধ করে দেন। মালিনসন বলেন, ‘সাবমেরিনটিতে খুব ঝাঁকুনি হচ্ছিল। সবকিছু ভেঙে যাচ্ছিল আর আমরা একদম নিচে নেমে যাচ্ছিলাম। আমরা কিছু সাদা কাপড় খুঁজে পেয়েছিলাম। সেগুলো মুখে রেখেছিলাম, যাতে জিহ্বায় কামড় না দিই।’

মালিনসন আরও বলেন, বেঁচে আছেন বুঝে তাঁরা বেশ স্বস্তি পেয়েছিলেন। পরে তাঁরা জানতে পেরেছেন, সাবমেরিনটি আসলে দ্রুত গতিতে বিধ্বস্ত হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা আহত হইনি। আমরা পাইপের সঙ্গে ঝুলে ছিলাম। পরে সেখানে একটি টর্চ নিয়ে বসেছিলাম।’

দুর্ঘটনার একপর্যায়ে দুই নাবিক টেলিফোনে যোগাযোগ করেছেন। তাঁরা বার্তা পাঠিয়েছিলেন, দুজনেই ভালো আছেন, মনোবল শক্ত আছে। চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
সাবমেরিনে ১ সেপ্টেম্বর সকাল পর্যন্ত অক্সিজেন সরবরাহ থাকবে। সাবমেরিনটিতে ৭২ ঘণ্টার অক্সিজেন মজুত ছিল। ইতিমধ্যেই ডুবে আট ঘণ্টার অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছে। বাকি আছে ৬৬ ঘণ্টা।

চ্যাপম্যান বলেন, দুর্ঘটনার পর তাঁরা প্রথম কয়েক ঘণ্টা জিনিসপত্র সব নতুন করে সাজিয়ে কাটিয়েছেন। সাবমেরিনটি প্রায় উল্টো হয়ে গিয়েছিল, তাই নতুন করে সব সাজাতে হয়েছিল। কিট মেরামত করতে হয়েছিল এবং নিশ্চিত হতে হয়েছিল, কোথাও কোনো ফুটো নেই।

মালিনসন বলেন, ‘অক্সিজেন কম খরচ করতে আমরা দুজন খুব কম কথা বলতাম। শুধু ঠিক আছি কি না নিশ্চিত হতে একে অন্যের হাত ধরে ছিলাম। অতিরিক্ত ঠান্ডায় খাবারে বিষক্রিয়া হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম আমি। কিন্তু আমাদের চিন্তা ছিল, বেঁচে থাকতে হবে।’

দুর্ঘটনার বার্তা পেয়ে উদ্ধারকারী জাহাজ ভাইকার্স ভেনচারার দ্রুত উদ্ধারকাজ শুরু করে দেয়। রয়্যাল নেভির এইচএমএস হেকেটকে বিশেষ দড়ির সাহায্যে ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। আর আরএএফ নিমরড উড়োজাহাজ সার্বক্ষণিক ওপরে মহড়া দিচ্ছিল। এ ছাড়া সমুদ্র থেকে বোমা উদ্ধারে বিশেষভাবে তৈরি মার্কিন নৌবাহিনীর সাবমেরিন কার্ভ থ্রি ও কানাডার কোস্টগার্ডের জাহাজ জন ক্যাবট সোয়ানসিও উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছিল।

৩০ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় মূল জাহাজ ভাইকার্স ভয়েজার উদ্ধারকাজে রওনা হয়। ইতিমধ্যে চ্যাপম্যান ও মালিনসনের খাবার প্রায় ফুরিয়ে আসছিল। তাঁদের খাবারের মতো আর মাত্র একটি চিজ ও চাটনি স্যান্ডউইচ এবং এক বোতল লেমোনেড ছিল।
মালিনসন বলেন, ‘আমাদের পরিবারের কথা খুব মনে হচ্ছিল। অতিরিক্ত ঠান্ডায় আমাদের হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছিল।’

উদ্ধারের পর উদ্ধারকারী সাবমেরিন ভাইকার্সে উঠছেন নাবিক রজার চ্যাপম্যান ও রজার মালিনসন

৩১ আগস্ট শুক্রবার দিনটি চ্যাপম্যান ও মালিনসনের জন্য খুবই বিপর্যয়কর ছিল। ওই দিন রাত দুইটায় প্রথমে উদ্ধারকারী একটি সাবমেরিন এলেও দড়ি ছিঁড়ে যাওয়ায় সেটি আর কাজ করতে পারেনি। সাবমেরিনটিকে আবার ফিরে যেতে হয়। এরপর আরেকটি এলেও তা শক্তি শেষ হওয়ার আগপর্যন্ত ডুবে যাওয়া সাবমেরিনটিকে খুঁজে পায়নি। এ কারণে সেটিও ফিরে যায়। প্রায় বেলা একটার দিকে একটি সাবমেরিন ডুবে যাওয়া সাবমেরিনটির খোঁজ পায়। কিন্তু এই সাবমেরিনও উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়। এরপর আরও তিনটি উদ্ধারকারী সাবমেরিনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ইতিমধ্যে চ্যাপম্যান ও মালিনসনের লিথিয়াম ফুরিয়ে গেছে। ৭২ ঘণ্টার অক্সিজেনও প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাঁরা বাঁচার আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

১ সেপ্টেম্বর ভোর পাঁচটার একটু পর একটি উদ্ধারকারী সাবমেরিন বিধ্বস্ত সাবমেরিনটির কাছে পৌঁছায় এবং উদ্ধারপ্রক্রিয়া শুরু করে। এরপর সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে কার্ভ থ্রি নামের আরেকটি সাবমেরিন ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। কিন্তু তারপরও চ্যাপম্যান ও মালিনসন ভরসা পাচ্ছিলেন না। তাঁদের ধারণা ছিল, এই দুই উদ্ধারকারী সাবমেরিনের প্রচেষ্টাও শেষমেশ ব্যর্থ হয়ে যাবে। তবে সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে বিধ্বস্ত সাবমেরিনটি টেনে তোলার কাজ শুরু হয়। সমুদ্রতীরে আসার পরও ছয় ফুট ব্যাসের স্টিলের বলের ভেতর আটকা দুজনকে বের করতে আরও ৩০ মিনিট সময় লেগে যায়।

টানা ৮৪ ঘণ্টা ৩০ মিনিট পর চ্যাপম্যান ও মালিনসন আকাশ দেখতে পেয়েছিলেন। সাবমেরিনে ৭২ ঘণ্টার লাইফ সাপোর্ট থাকলেও আরও প্রায় সাড়ে ১২ ঘণ্টার লাইফ সাপোর্ট পেয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের যখন উদ্ধার করা হয়, তখন সিলিন্ডারে আর ১২ মিনিটের অক্সিজেন অবশিষ্ট ছিল।

উদ্ধারের পর রজার চ্যাপম্যান নিখোঁজ হওয়া সাবমেরিন উদ্ধারকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। আর মালিনসন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সাবমেরিনেই কাজ করেন। তাঁরা প্রতিবছর একবার দেখা করতেন। ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে ৭৪ বছর বয়সে চ্যাপম্যানের মৃত্যু হয়।