ইউক্রেনে দুই বছরের বেশি সময় ধরে চলছে রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযান। এ যুদ্ধে পশ্চিমা সহায়তাপুষ্ট ইউক্রেন বাহিনী একসময় বেশ অগ্রগতি দেখিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তেমন নেই। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যের জয়েন্ট ফোর্সেসের সাবেক কমান্ডার জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনসের আশঙ্কা, চলতি বছরেই ইউক্রেন যুদ্ধে পরাজিত হতে পারে।
এমন আশঙ্কার কারণ কী? রিচার্ড ব্যারনসের ভাষ্যমতে, ‘একটা পর্যায়ে ইউক্রেন বুঝতে পারবে, তারা এই যুদ্ধে জয় পাবে না। আর সেই পর্যায়ে পৌঁছালে কেনই–বা দেশটির মানুষ লড়াই করতে চাইবে? আরও মরতে চাইবে শুধুই অপ্রতিরোধ্যকে প্রতিরোধ করার জন্য?’
ইউক্রেনে সেই পর্যায় এখনো আসেনি। তবে দেশটির সেনাসদস্য, অস্ত্রশস্ত্র ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসছে। রাশিয়ার দখল করা অঞ্চলগুলো উদ্ধার করতে গত বছর তারা যে পাল্টা হামলা শুরু করেছিল, তা-ও ব্যর্থ হয়েছে। মস্কো এখন আগামী গ্রীষ্মে জোর হামলার তোড়জোড় শুরু করেছে।
রিচার্ড ব্যারনসের ভাষ্যমতে, রাশিয়া যে হামলা চালাতে যাচ্ছে, তা মোটামুটি স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে যুদ্ধের সম্মুখসারিতে ভালো অবস্থানে রয়েছে রুশ বাহিনী। কামান ও গোলাবারুদের দিক দিয়েও ইউক্রেনের চেয়ে বহু এগিয়ে রয়েছে তারা। নিত্যনতুন অস্ত্র ব্যবহারের কারণে রুশ সেনারা চাঙাও হয়ে উঠছেন।
নতুন এই অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে এফএবি গ্লাইড বোমা। সোভিয়েত আমলে ‘ডাম্ব বোম্ব’ নামে পরিচিত একটি বোমায় পাখা লাগিয়ে ও জিপিএস ব্যবস্থা যুক্ত করে উন্নত করা হয়েছে। এই বোমার বিস্ফোরকের ওজন দেড় হাজার কেজি। এফএবি গ্লাইড বোমার ব্যবহার ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তছনছ করে দিয়েছে।
চলতি বছরের গ্রীষ্মে রাশিয়া বড় ধরনের হামলা চালাতে পারে—এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্যারনস বলেন, যদি এমনটি ঘটে, তাহলে ইউক্রেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে রুশ বাহিনীর প্রবেশের ঝুঁকি দেখা দিতে পারে। আর তারা হয়তো এমন সব এলাকায় পৌঁছে যাবে, যেখানে ইউক্রেন বাহিনীর সক্ষমতা নেই তাদের থামানোর।
এখানে একটা প্রশ্ন আসে, তা হলো, সেই এলাকাগুলো কোথায়?
গত বছর রুশ বাহিনী জানত ইউক্রেনীয়রা কোথায় হামলা চালাতে পারে। সে অনুযায়ী তারা পরিকল্পনা করে ইউক্রেনের অগ্রগতি সফলভাবে থামিয়ে দিয়েছিল। তবে নৌকার হাল এখন মস্কোর হাতে। ইউক্রেনে তারা সেনাসংখ্যা বাড়িয়েছে। এখন কিয়েভই উল্টো চিন্তায় পড়েছে—রাশিয়া কোথায় হামলা চালাতে পারে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের (আরইউএসই) জ্যেষ্ঠ গবেষক জ্যাক ওয়াটলিং বলেন, ইউক্রেনে যুদ্ধের সম্মুখসারি অনেক দীর্ঘ। এই সম্মুখসারি রক্ষার সক্ষমতা থাকতে হবে ইউক্রেনের। তাদের তা নেই। ফলে ইউক্রেন বাহিনী বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাবে। প্রশ্ন হলো, কতটা অঞ্চল এর শিকার হতে যাচ্ছে?
ইউক্রেনের কোন অঞ্চলে রাশিয়া শক্তি প্রয়োগ করবে, সে বিষয়ে হয়তো রুশ সামরিক কর্মকর্তারা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। তবে এ অঞ্চলগুলোকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর খারকিভ। অবস্থান রুশ সীমান্তের খুব কাছে। তাই মস্কোর জন্য শহরটি একটি লোভনীয় নিশানা হতে পারে। জ্যাক ওয়াটলিংয়ের মতে, খারকিভ অনেক নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে।
এখন প্রতিদিনই খারকিভে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। রুশ বাহিনীর ড্রোন এবং ক্রুজ ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে সেখানে পর্যাপ্ত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েন করতে পারেনি ইউক্রেন।
রিচার্ড ব্যারনস বলেন, এ বছর রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হবে দনবাস (দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক) অঞ্চল। এরপর তাদের নজর থাকবে খারকিভে। শহরটি রাশিয়া সীমান্ত থেকে মাত্র ২৯ কিলোমিটার দূরে। এই শহরটি জয় রাশিয়ার জন্য বড় উপহার হবে।
পূর্ব ইউক্রেনের অঞ্চলগুলো একত্রে দনবাস নামে পরিচিত। ২০১৪ সালে এ অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা দেয় রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা। এরপর থেকেই তাদের সঙ্গে ইউক্রেন বাহিনীর সংঘাত চলছে।
২০২২ সালে গণভোটের আয়োজন করে দনবাস অঞ্চলকে রাশিয়ার ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার ঘোষণা দেয় মস্কো। ১৮ মাস ধরে এ অঞ্চলেই বেশির ভাগ লড়াইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এই অঞ্চলের দুটি শহর—বাখমুত ও আভদিভকা রক্ষার জোর চেষ্টা চালিয়েছিল ইউক্রেন। তবে দুটোই হারিয়েছে তারা। এ সময় নিহত হয়েছেন ইউক্রেনের সেরা সেনাদের বেশ কয়েকজন।
ইউরোপে মার্কিন সামরিক বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল ক্রিস্টোফার কাভোলি সতর্কতা প্রকাশ করে বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ না করে, তাহলে ইউক্রেন বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ার তুলনায় বহু পিছিয়ে পড়বে। অনুপাতটা হতে পারে ১০-১।
দক্ষিণ ইউক্রেনের জাপোরিঝঝিয়া শহর যুদ্ধের সম্মুখসারির খুব কাছে। জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের রাজধানী এই শহর। মস্কো জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলকে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করলেও রাজধানী শহরটি এখনো ইউক্রেনীয়দের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তবে ইউক্রেনের হামলার আশঙ্কায় জাপোরিঝঝিয়ার দক্ষিণে গত বছর রাশিয়া যে অপ্রতিরোধ্য প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল, সেটাই এখন রাশিয়ার অগ্রগতির বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেখানে তিন স্তরের প্রতিরক্ষার মধ্যে বিপুল পরিমাণ মাইন স্থাপন করে রেখেছে রুশ বাহিনী। এর কিছুটা হয়তো তারা নিষ্ক্রিয় করতে পারে। তবে রাশিয়া এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে তা অবশ্যই ইউক্রেনীয়দের নজরে আসবে।
যদিও এ বছরে ইউক্রেনে রাশিয়ার কৌশলগত লক্ষ্য কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল ঘিরে না-ও হতে পারে। তারা যেটা করতে পারে তা হলো, ইউক্রেনের লড়াই করার স্পৃহা নস্যাৎ করে দেওয়া, আর ইউক্রেনের পশ্চিমা মিত্রদের এটা মনে করানো যে এই যুদ্ধে জয় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।