সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে তৈরি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন মানুষজন। গতকাল মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে
সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে তৈরি অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন মানুষজন। গতকাল মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে

আইএস না ইউক্রেন, মস্কোয় হামলায় দায়ী কে

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩৩। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) হামলার দায় স্বীকার করলেও রাশিয়া দাবি করেছে, এই হামলার সঙ্গে ইউক্রেন জড়িত। অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে কিয়েভ।

গতকাল শনিবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, হামলাকারীরা ইউক্রেন সীমান্ত দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল। তারা ইউক্রেনে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রাথমিক তথ্যে জানা যাচ্ছে, হামলাকারীদের ইউক্রেনে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সীমান্তে প্রস্তুতি রাখা হয়েছিল।

ভ্লাদিমির পুতিন আরও বলেন, চার অস্ত্রধারীসহ হামলাকারীদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

তবে হামলার পরপরই দায় স্বীকার করে আইএস জানিয়েছিল, তাদের ‘যোদ্ধারা’ মস্কোর উপকণ্ঠে একটি বড় জমায়েতে হামলা চালিয়েছেন। এরপর নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরেছেন তাঁরা।

মস্কোর হামলা নিয়ে গতকাল এক বিবৃতিতে আইএস বলেছে, হামলায় তাদের চার যোদ্ধা অংশ নেন। আইএস ও ইসলামবিরোধী দেশগুলোর চলমান যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই হামলা চালানো হয়েছে। তবে মস্কোর হামলায় তাদের কোন শাখা জড়িত ছিল, বিবৃতিতে তা খোলাসা করা হয়নি।

শুক্রবার রাত আটটার দিকে মস্কোর শহরতলির ক্রোকাস সিটি হলে ঢুকে সেখানে সমবেত লোকজনকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে এক দল বন্দুকধারী। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে রাশিয়া। তাঁদের মধ্যে হামলায় অংশ নেওয়া চার অস্ত্রধারীও রয়েছেন। রাশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গতকাল এক বিবৃতিতে জানায়, চার অস্ত্রধারী রাশিয়ার নাগরিক নন। তাঁরা সবাই বিদেশি।

সোভিয়েত আমলের ব্যান্ড দল পিকনিক-এর কনসার্ট দেখতে ক্রোকাস সিটি হলে সমবেত হয়েছিলেন হাজারো মানুষ। এ সময় মুখোশ পরা এক দল বন্দুকধারী সেখানে হামলা চালায়।

রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা এফএসবি জানিয়েছে, হামলার পরপরই সন্ত্রাসীরা রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তের দিকে পালিয়ে যান। ইউক্রেন সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। সংস্থাটির মতে, ইউক্রেনের সঙ্গে হামলাকারীদের যোগাযোগ ছিল। তবে এ নিয়ে আর বিস্তারিত কিছু বলেনি সংস্থাটি। রাশিয়ার কিছু আইনপ্রণেতাও দাবি করছেন, এ হামলার সঙ্গে কিয়েভ জড়িত।

রাশিয়ার একজন জ্যেষ্ঠ পার্লামেন্ট সদস্য আন্দ্রে কারতাপোলভ বলেন, এ হামলার মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি স্বার্থ হাসিল হয়েছে সম্ভবত ইউক্রেন ও তাদের মদদদাতাদের।

তবে কিয়েভ দাবি করছে, এ হামলায় তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই। রাশিয়ার অভিযোগের পর গতকাল এক বিবৃতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক বলেন, ‘এই হামলায় ইউক্রেনের কিছুই করার নেই। রাশিয়ার সঙ্গে দেশ হিসেবে আমাদের সর্বাত্মক যুদ্ধ চলছে।’

নিহতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধির শঙ্কা

ক্রেমলিন জানিয়েছে, হামলার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হামলায় আহত শতাধিক ব্যক্তি এখনো হাসপাতালে ভর্তি। রাশিয়ার জরুরি পরিস্থিতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বরাতে গতকাল রাতে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলো ক্রোকাস সিটি হলে আগুন নেভানোর খবর জানিয়েছে।

রাশিয়ায় বড় বড় অপরাধের বিষয়গুলো তদন্ত করে থাকে দেশটির ইনভেস্টিগেটিভ কমিটি। গতকাল রাতে সংস্থাটি বিবৃতিতে জানায়, এ পর্যন্ত ১৩৩ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

তদন্তকারীরা বলছেন, ছয় হাজার আসনবিশিষ্ট হলটিতে কনসার্ট উপভোগ করতে ধারণক্ষমতার বাইরে লোকজন জড়ো হন। ফলে বন্দুকধারীদের গুলি ছাড়াও আগুন, ছাদ ধসে এবং দম বন্ধ হয়েও অনেকে মারা গেছেন। কারণ, এলোপাতাড়ি গুলির পাশাপাশি সন্ত্রাসীরা দাহ্য তরল পদার্থ দিয়ে হল প্রাঙ্গণে আগুন ধরিয়ে দেন। আগুন দ্রুত পুরো হলে ছড়িয়ে পড়ে।

সতর্ক করার দাবি যুক্তরাষ্ট্রের

যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, সম্ভাব্য হামলার বিষয়ে আগেই রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাকে সতর্ক করেছিল তারা। ওয়াশিংটনের দাবি, রাশিয়াকে সতর্ক করে তারা বলেছিল, মস্কোতে শিগগিরই হামলা হবে। তবে রাশিয়া তা আমলে নেয়নি।

হামলার তিন দিন আগেও পুতিনকে প্রকাশ্যে পশ্চিমা বিশ্বের সতর্কতার সমালোচনা করতে দেখা গেছে। পুতিন বলেছিলেন, রাশিয়ার নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর জন্য হামলার আতঙ্ক ছড়াচ্ছে পশ্চিমারা।

হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র আদ্রিয়েনে ওয়াটসন বলেন, সম্ভাব্য এই সন্ত্রাসী হামলা-সংক্রান্ত তথ্য রাশিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ওয়াশিংটন।

কিন্তু গত মঙ্গলবার এফএসবির প্রধানের সঙ্গে আলোচনার সময় পুতিন বলেছিলেন, ‘রাশিয়ায় সম্ভাব্য সন্ত্রাসী হামলার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর কিছু কর্মকর্তা সম্প্রতি বিবৃতি দিয়েছেন। এই অপপ্রচারের মাধ্যমে আমাদের সমাজে অস্থিতিশীলতা তৈরি ও হস্তক্ষেপের চেষ্টা চলছে।’

৮ মার্চ রাশিয়ায় মার্কিন দূতাবাস একটি নিরাপত্তা–সতর্কতা জারি করে। এতে বলা হয়, মস্কোতে কনসার্টসহ বড় কোনো জমায়েতে শিগগিরই চরমপন্থীরা হামলার পরিকল্পনা করছে। এ-সংক্রান্ত খবর পাওয়ার পর বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছে তারা। রাশিয়ায় থাকা মার্কিন নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছে দূতাবাস।

বৈশ্বিক নিন্দা

রয়টার্সের খবরে বলা হয়, মস্কোতে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদসহ বিভিন্ন দেশ। নিরাপত্তা পরিষদ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতিতে বলেছে, হামলাকারী, তাদের মদদদাতা, অর্থদাতা ও পৃষ্ঠপোষকদের বিচারের আওতায় আনায় জোর দিচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদ।

হামলার নিন্দা জানিয়ে পুতিনকে শোকবার্তা পাঠিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং। তিনি বলেছেন, জাতীয় নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে রাশিয়ার যেকোনো পদক্ষেপে অকুণ্ঠ সমর্থন থাকবে বেইজিংয়ের।

মস্কোর হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। গতকাল তিনি বলেছেন, রাশিয়ার জনগণের প্রতি সংহতি জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। যেকোনো সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার নিন্দা জানায় ওয়াশিংটন।

ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি বলেছেন, মস্কোতে নিরীহ লোকজনের ওপর এ হত্যাযজ্ঞ অগ্রহণযোগ্য। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, মস্কোতে যা ঘটেছে, তা ভয়ংকর। জার্মানি বলেছে, এই হামলার নেপথ্য কারণ দ্রুত উদ্‌ঘাটন করতে হবে।

মস্কোতে সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, এই দুঃসময়ে রাশিয়ার সরকার ও দেশটির জনগণের পাশে রয়েছে ভারত।

এ ছাড়া সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কিউবা, ভেনেজুয়েলা, মিসর, নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড, সিরিয়া, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশ মস্কোর এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে।