নিষেধাজ্ঞার কারণে গত ছয় মাসে বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে বদলে গেছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের তিন দশক পর রাশিয়া বৈশ্বিক পুঁজিবাদের ছায়াতলে এসে দাঁড়িয়েছিল। এমনকি মস্কোর সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর রাজনৈতিক সম্পর্কের প্রায়ই টানাপোড়েন সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন মজবুত হচ্ছিল। মধ্যবিত্ত রাশিয়ানরা বেশ সহজে ইউরোপের ফ্লাইটে চাপতে পারছিলেন বা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে জিনস পর্যন্ত পশ্চিমাদের তৈরি হাল আমলের ভোগ্যপণ্য কিনতে পারছিলেন। এ ছাড়া অর্থ আদান-প্রদানের মতো সাধারণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো সম্পন্ন করছিলেন খুব সহজে।
তবে এখন বোধ হয় সেই সময় একেবারে শেষ হয়ে গেছে। ইউক্রেনে ক্রেমলিনের সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ও এশিয়ায় তাদের মিত্র দেশগুলো মস্কোর ওপর একের পর এক নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু ও বিচ্ছিন্ন করতেই এ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে তারা।
পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়া তার বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের প্রায় অর্ধেক তুলতে পারছে না। বৈশ্বিক আর্থিক লেনদেনব্যবস্থা সুইফট থেকে রুশ ব্যাংকগুলোকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞা দেওয়া দেশগুলোর আকাশসীমা ও বন্দরে ভিড়তে পারছে না রুশ উড়োজাহাজ ও জাহাজ। রাশিয়ার কিছু অত্যাধুনিক প্রযুক্তি খাতের ওপরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। তাই এসব পণ্য রপ্তানি করতে পারছে না মস্কো। নিষেধাজ্ঞার কবলে তাদের তেল আর কয়লাও।
একই সঙ্গে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর ১ হাজার ২০০-এর বেশি বিদেশি কোম্পানি হয় রাশিয়া থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে, নয় কার্যক্রমের পরিসর ছোট করেছে। এ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে ইয়েল ইউনিভার্সিটির চিফ এক্সিকিউটিভ লিডারশিপ ইনস্টিটিউট থেকে। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, মাস্টারকার্ড, ভিসা, আইকিয়া ও ম্যাকডোনাল্ডস। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও পদক্ষেপ নিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা চলছেই।
তবে এখন পর্যন্ত নতুন এসব নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতির জন্য মিশ্র ফলই বয়ে এনেছে। একদিকে রাশিয়ার মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) গত অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের তুলনায় এ বছর ৪ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে সেটা ৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশ্লেষকেরা। নতুন করে এসব নিষেধাজ্ঞা শুধু দেশটির মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে যায়নি, একই সঙ্গে উৎপাদনের জন্য পণ্য আমদানি করতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় দেশটির উৎপাদনও অনেক কমে গেছে। দেশটির পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও ওই পণ্যগুলো খুব জরুরি। উদাহরণস্বরূপ রাশিয়ার গাড়ি উৎপাদন ৬১ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে।
রাশিয়ার অনেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, বিশেষ করে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কিছু প্রযুক্তি পণ্যের বিকল্প উৎস পাওয়াটা তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠেছে, যেমন মাইক্রোচিপ। এখনো পশ্চিমা দেশের প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মূলত মাইক্রোচিপের উন্নয়ন ঘটানো হয়।
তবে পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া শুরু করলে অনেকে যেমন আশঙ্কা করেছিলেন, রাশিয়ার অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, তেমনটা কিন্তু হয়নি। এর বদলে নিষেধাজ্ঞার বিকল্প হিসেবে নানা পদক্ষেপ নিয়ে দেশটি চমকে দিয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর ওই মাসের শেষ দিকে রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দরপতন হয় ৩০ শতাংশের বেশি। তবে এর পর থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রুবল। শুধু তা-ই নয়, চলতি বছর বিশ্বের যেসব মুদ্রা ভালো করেছে, সেসবের মধ্যে শীর্ষেই রয়েছে রুবল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতিও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। গত এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি যেখানে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ গিয়ে ঠেকেছিল, আগস্টে সেটা ছিল ১৪ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া রাশিয়ার নগদ তহবিলও রয়েছে রেকর্ড পরিমাণে। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এর পরিমাণ ছিল ১৬৭ বিলিয়ন, যা আগের বছরের তিন গুণ।
নিষেধাজ্ঞা এখন পর্যন্ত অন্তত মস্কোর মানুষের জীবনে ততটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। রাশিয়ার রাজধানী শহরের সড়কগুলো প্রতিবছর সংস্কার করা হয়। এ বছরও নগরের সব সড়কে নির্মাণশ্রমিকদের কর্মযজ্ঞ দেখা গেছে। রেস্তোরাঁ, পানশালা ও ক্যাফেতে উচ্ছ্বসিত মানুষের আনাগোনা দেখা গেছে। বিপণিবিতানও জনাকীর্ণ; যদিও পশ্চিমা মালিকানাধীন অনেক পণ্যের দোকান এখন বন্ধ। মুদিদোকানেও ক্রেতারা পণ্য কিনতে ভিড় করছেন।
মস্কোর সেই জাদুঘরকর্মী আলেকজান্ডার বললেন, ‘মানুষ ক্রমাগত উদ্বিগ্ন বোধ করে ক্লান্ত, তাই তাঁরা আরও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। রেস্তোরাঁয় খাওয়া কমিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে দেখছি, খুব অল্পসংখ্যক মানুষই খাওয়া কমিয়েছেন। আগের চেয়ে কম থাকলেও এখনো তাঁদের হাতে বেশ অর্থ আছে।’
গত মাসে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২০২২ সালের জন্য রাশিয়ার অর্থনীতি সম্পর্কে পূর্বাভাস পরিবর্তন করে জানায়, জিডিপি ৬ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। আগের পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, জিডিপি ৮ দশমিক ৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। আগের পূর্বাভাস বদলে হার কমিয়ে দেওয়া হলেও এটি এখনো অনেক বেশি। কিন্তু প্রথম দিকে অনেকে যে রকম বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন, তার তুলনায় এ হার অনেক কমই।
নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাশিয়ার অর্থনীতি কেন স্থিতিশীল, সেটির ব্যাখ্যা দেন মস্কোভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এক্সপার্ট আরএর প্রধান অর্থনীতিবিদ অ্যান্তন তাবাখ। তিনি বলেন, প্রথম ছয় মাসে নতুন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ার পর দুটি বিষয় রাশিয়ার অর্থনীতি সচল রাখতে কাজ করেছে। প্রথমটি হলো, ভোগ্যপণ্যের রপ্তানি অনেক বেড়ে যাওয়া; বিশেষ করে জ্বালানির। রাশিয়ার সরকারি একটি নথি দেখেছে রয়টার্স। তা থেকে জানা যাচ্ছে, জ্বালানি তেল বিক্রি করে এ বছর ৩৩৭ বিলিয়ন ডলার আয়ের আশা রাশিয়ার, যা গত বছরের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি। দ্বিতীয় কারণ হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সরকারি ব্যয় বেড়ে যাওয়া।
অ্যান্তন তাবাখ বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি বেড়ে ভোগ্যপণ্যের চাহিদা কমে যাওয়ায় ও নতুন নিষেধাজ্ঞায় রাশিয়ার রপ্তানি বৃদ্ধি সম্ভবত চূড়ায় পৌঁছেছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, চলতি বছরের শুরুতে রাশিয়ার আমদানি হঠাৎ অনেকটা কমে যায়। অবশ্য এখন ধীরে ধীরে সেটা বাড়ছে। অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে রুবলের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধ লজিস্টিকস।
তাবাখ বলেন, ‘এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে কাঠামোগত সংস্কারের কথা বলছে, রুশ অর্থনীতি সেটা কীভাবে মোকাবিলা করবে। ভোক্তার নতুন পণ্যের দিকে ঝোঁকা, নতুন সরবরাহব্যবস্থা, আর্থিক লেনদেনের নতুন পদ্ধতি ও নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় কোম্পানিগুলোর নতুন পদক্ষেপ নিয়ে এখন আমরা আলোচনা করছি। আমার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা, আমরা এখন এ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে কঠিন পর্যায়ে আছি। এটা আরও ৯ মাস থেকে এক বছর দীর্ঘ হতে পারে।’
রাশিয়ার কিছু উদ্যোক্তার জন্য নিষেধাজ্ঞা নজিরবিহীন সব সুযোগ নিয়েই হাজির হয়েছে। ‘অপোরা রাশিয়া’ নামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মালিকদের একটি জাতীয় সংগঠনের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাই দুনায়েভ বলছিলেন, রাশিয়া থেকে একে একে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার কারণে দেশীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের জন্য সেই বাজার ধরার সুযোগ তৈরি হয়েছে, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য, প্রসাধনী, পোশাক, পর্যটক ও নির্মাণ খাতে এ সুযোগ তৈরি হয়েছে বেশি।
নিকোলাই দুনায়েভ বলেন, ‘মোটের ওপর ভোক্তাদের মধ্যে চাহিদা কমেছে। কিন্তু রাশিয়ায় সেটা অতটা অনুভূত হচ্ছে না। কারণ, এসব চাহিদার বেশির ভাগ দেশীয় পণ্য উৎপাদন প্রতিষ্ঠান পূরণ করেছে। নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় রাশিয়া যে কৌশল নিয়েছে, তাতে পশ্চিমা নয় এমন দেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক দশকে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে উৎপাদন যেভাবে বেড়েছে, তাতে পশ্চিমা বেশির ভাগ পণ্যের বিকল্প হিসেবে এসব দেশের পণ্য রাশিয়ার কাজটা সহজ করেছে।
একই সঙ্গে বিকল্প আমদানিপদ্ধতিতে অর্থনীতির শূন্যতা পূরণ করা শুরু করেছে মস্কো। পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর তৈরি স্মার্টফোন, গাড়ি ও পোশাক তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে আমদানি করছে রাশিয়ার কোম্পানিগুলো। এরপর এসব পণ্যে ট্রেডমার্ক করা প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নিয়ে তা রাশিয়ার বাজারে বিক্রি করছে।
তাবাখ বলেন, ‘এ ধরনের উপায় বা পদ্ধতি প্রায় সবক্ষেত্রেই বেশি ব্যয়বহুল ও ব্যবহারকারীদের জন্যও তা তত উপকারী নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব পদ্ধতি নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলায় রুশ অর্থনীতির জন্য বেশ সহায়ক হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এর মধ্য দিয়ে এ বিষয়ই দেখা যাচ্ছে, তিন দশক আগেও বাজারে যেখানে পশ্চিমাদের একক আধিপত্য ছিল, সেটা এখন নেই। এখন আগের পরিস্থিতির অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের হাতে এখন নতুন নতুন সব উপায় তৈরি হয়েছে।’
তবে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, সেটা হলো, কাঠামোগত এসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে কতটা টেকসই হতে পারবে রাশিয়ার অর্থনীতি। নতুন একটি ভিত্তি কাঠামোয় কতটা সফলভাবে দাঁড়াতে পারবে রাশিয়ার অর্থনীতি অথবা অর্থনীতি ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পতনের মধ্য দিয়ে আরও বড় ধস নামবে কি?
ডেজান শায়রা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ক্রিস ডেভোনশায়ার-এলিসের মতে, গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিষয় রয়েছে, যা রাশিয়ার পক্ষে কাজ করতে পারে। প্রথমটি হলো, রাশিয়ার অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির আকার বাড়ানোর জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আপনি রাশিয়ার দিকে তাকান, বিশ্বজুড়ে প্রাকৃতিক সম্পদের যে মজুত রয়েছে, তার প্রায় সবকিছুর ক্ষেত্রে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। জ্বালানি থেকে শুরু করে হীরা, সুপেয় পানি থেকে পৃথিবীর বিরল ও অন্যান্য সব খনিজ পদার্থের মজুত আছে তাদের। প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে রাশিয়া অনেক ধনী একটি দেশ।’
ক্রিস ডেভোনশায়ার বলেন, ‘পশ্চিমাদের সঙ্গে চলমান টানাপোড়েন সত্ত্বেও ভূরাজনৈতিকভাবে একঘরে হওয়া থেকে এখনো অনেক দূরে রাশিয়া। রাশিয়ার আছে শক্তিশালী কিছু বন্ধুপ্রতিম দেশ, যেমন চীন, ভারত ও ইরান। এ ছাড়া ক্ষমতা বাড়তে থাকা কিছু দেশ, যেমন সৌদি আরব, তুরস্ক, ব্রাজিল ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশের সঙ্গে রাশিয়ার রয়েছে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এত সব বিষয় বিবেচনা করে আমার মনে হয়, রাশিয়া পিছিয়ে পড়বে না, বরং আরও এগিয়েই যাবে।’
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। অনুবাদ: আল-আমিন সজীব