এক বিস্ফোরণে গতকাল শীর্ষস্থানীয় রুশ সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইগর কিরিলভ নিহত হন। বিস্ফোরণের পর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা
এক বিস্ফোরণে গতকাল শীর্ষস্থানীয় রুশ সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইগর কিরিলভ নিহত হন। বিস্ফোরণের পর হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরিদর্শন করছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা

রুশ কর্মকর্তারা ইউক্রেনের গুপ্তচরদের বেপরোয়া আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন

অভিযানটি ছিল অবাক করার মতো পুঙ্খানুপুঙ্খ। একটি বৈদ্যুতিক স্কুটারের ভেতরে বিস্ফোরক লুকানো ছিল। দূরনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের সাহায্যে সেটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ইউক্রেনের কয়েকটি সূত্র বিবিসিকে এমনটা জানিয়েছে।

এ বিস্ফোরণেই নিহত হয়েছেন শীর্ষস্থানীয় রুশ সামরিক কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইগর কিরিলভ। ধারণা করা হচ্ছে, তিনিই প্রথম কোনো রুশ উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা, যিনি ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরুর পর যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে নিহত হলেন। তাঁকে হত্যার ঘটনা রাশিয়ার সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে হতবাক করেছে। ইউক্রেনের গোয়েন্দা সংস্থা সিকিউরিটি সার্ভিস অব ইউক্রেন-এসবিইউর বিভিন্ন সূত্র বলেছে, এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তারাই জড়িত।

নিজেদের ভূখণ্ডেও রুশ বাহিনীকে লক্ষ্য করে এর আগে অসংখ্য অভিযান চালিয়েছে ইউক্রেন।

কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব মস্কোয় নিজ বাড়ির বাইরে রুশ সামরিক বাহিনীর ‘বিকিরণ, জৈবিক ও রাসায়নিক সুরক্ষা বাহিনী’র প্রধান কিরিলভকে হত্যা এ ইঙ্গিত করছে, ইউক্রেনের গোয়েন্দারা রাশিয়ায় ঢুকে তাঁর মতো শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের নিশানা বানানোর সক্ষমতা রাখেন। ওই হত্যাকাণ্ড রাশিয়ার নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেনের সক্ষমতা কত দূর যেতে পারে, তা নিয়েও কৌতূহল জাগাচ্ছে।

কিরিলভের ওপর আক্রমণের জন্য একটি স্কুটার বেছে নেওয়ার বিষয়টি ছিল ‘বিচক্ষণ’ পদক্ষেপ। মস্কোর রাস্তাঘাটে প্রায় সব জায়গায় পরিত্যক্ত স্কুটার দেখা যায়। এসব স্কুটারের দিকে কেউ তাকায় না বললেই চলে।

হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা সঠিক সময়ে বিস্ফোরক যন্ত্রটির বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। অর্থাৎ ইগর কিরিলভ যখন তাঁর সহকারীকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিলেন, ঠিক তখন বিস্ফোরণ ঘটে। এ ক্ষেত্রে সহজেই বোঝা যায়, অপরাধীরা ভুক্তভোগী দুজনের ওপর নজরদারি করছিলেন। তাঁরা হয়তো ক্যামেরার মাধ্যমে নয়তো সরাসরি তাঁদের ওপর চোখ রাখছিলেন।

ধারণা করা হয়, এটাই রাশিয়ার বড় শহরগুলোর রাস্তায় এসবিইউর মাত্র হত্যাকাণ্ড নয়। সুতরাং কীভাবে এসব অভিযান চালানো হয়, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে রাশিয়ায় রাজনীতিবিদ ও সামরিক কর্মকর্তাদের ওপর চলা আক্রমণের অন্য ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখলে।

যুদ্ধ নিয়ে জনপ্রিয় ব্লগ নির্মাতা ভ্লাদলেন তাতারস্কি ২০২৩ সালের এপ্রিলে সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি ক্যাফেতে একটি ‘সৃজনশীল সন্ধ্যা’য় ভক্তদের সঙ্গে দেখা করেন। স্ট্রিট ফুড বার নম্বর–১–এ অনুষ্ঠান চলাকালে শিল্পকলার শিক্ষার্থী পরিচয়ে দারিয়া ত্রেপোভা নামের একজন তাঁকে একটি ভাস্কর্য উপহার দেন। এর কয়েক মিনিট পর ভ্লাদলেন তাতারস্কি সৈনিকের মাথার আকৃতির শিল্পকর্মটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখার সময় সেটা বিস্ফোরিত হয়। এতে তিনি নিহত হন। আহত হন সেখানে উপস্থিত অনেকে।

পরবর্তী সময়ে এ ঘটনার বিচার চলাকালে দারিয়া বলেন, ভাস্কর্যটির ভেতরে বিস্ফোরক থাকার ব্যাপারে তিনি কিছুই জানতেন না।

দারিয়া বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু তিনি বলেন, তাঁকে বলা হয়েছিল যে, ভাস্কর্যটির ভেতরে একটি মাইক্রোফোন আছে। আদালত তাঁকে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দেন।

এসবিইউ শত্রুকে ঘায়েল করতে অন্তর্ঘাত থেকে শুরু করে বোমা বিস্ফোরণ পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এমনকি ভাড়াটে খুনিও পাঠাতে পারে, যা সম্ভবত গুপ্তহত্যার সবচেয়ে কুখ্যাত মাধ্যম।

এক বছর আগে ইউক্রেনের সাবেক রাশিয়াপন্থী আইনপ্রণেতা ইলিয়া কিভাকে মস্কোর বাইরের একটি গ্রামে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। খুনি সবার অলক্ষ্যে একটি হোটেল প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়তে সক্ষম হন। কিভা একটি পার্কে হাঁটাহাঁটি করছিলেন। এ সময় কিভাকে দুবার গুলি করেন খুনি।

ইউক্রেন এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি। তবে এসবিইউর সূত্রগুলো বলেছে যে এ হত্যার সঙ্গে সংস্থাটি জড়িত।

মাত্র পাঁচ দিন আগে রাশিয়ার শীর্ষস্থানীয় ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানী মিখাইল শাটস্কিকে মস্কোর বাইরের একটি জঙ্গলে গুলি করে হত্যা করা হয়। ইউক্রেনের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার ওপর এ হত্যাকাণ্ডের দায় চাপানো হয়েছিল। যদিও ্রএটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

শাটস্কি রাশিয়ার কেএইচ-৫৯ ও কেএইচ-৬৯ ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের আধুনিকীকরণ করেছেন। এ ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ও প্রাণহানি ঘটিয়েছে। শাটস্কিকে হত্যার কয়েক দিনের মধ্যেই কিরিলভকে হত্যা করা হলো। এতে বোঝা যায় যে ইউক্রেনের গুপ্তচরেরা রাশিয়ার কতটা গভীরভাবে অনুপ্রবেশ করেছেন।

শুধু রাশিয়ার রাজনীতিবিদ বা সামরিক বাহিনী–সংশ্লিষ্ট লোকজনই এ ধরনের হামলার শিকার হয়েছেন, এমন নয়।

২০২২ সালের আগস্টে ডরিয়া ডুগিনা নামের একজন একটি গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন। তিনি ছিলেন রুশ আদর্শবাদী। ডরিয়া তাঁর বাবা আলেকজান্ডার ডুগিনের কাছে পাঠানো এক বার্তায় ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন।

রাশিয়ার তদন্ত অনুসারে, ইউক্রেনের দুজন নাগরিক এ হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ইউক্রেন যে নিজেদের শত্রুকে নির্মূল করার জন্য রাশিয়ার অভ্যন্তরে লোক পাঠাচ্ছে, এটিও তার উদাহরণ।

নাটালিয়া ভভক (৪৩) পূর্ব ইউক্রেনের রুশ অধিকৃত দোনেৎস্ক অঞ্চল থেকে রাশিয়ায় প্রবেশ করেছিলেন। পরে তিনি ইউক্রেনের অন্য এক নাগরিকের সঙ্গে জুটি বাঁধেন। তাঁরা একটি গ্যারেজ ভাড়া নিয়েছিলেন। সেখানে তাঁরা বোমাটি সংযোজন করেন। তাঁদের বিচার চলাকালে অভিযোগ করা হয়েছিল, ডুগিনাকে হত্যার এক দিন আগেই ওই দুজন রাশিয়া থেকে পালাতে সক্ষম হন।

রাশিয়ার মাটিতে হওয়া এসব আক্রমণের ঘটনা দেখাচ্ছে, শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করতে ইউক্রেনের গোয়েন্দারা নানা রকম পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তবে কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, জেনারেল কিরিলভের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ইউক্রেন জড়িত না-ও থাকতে পারে।

কিয়েভভিত্তিক সামরিক পর্যবেক্ষক ইউরি কারিন বলেন, রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াইয়ের ফলে কিংবা যুদ্ধাপরাধের অন্যতম প্রধান সাক্ষীকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ক্রেমলিনের প্রচেষ্টার হিসেবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে।

কারিন আরও বলেন, যদি এসবিইউ এ হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তবে বার্তাটি পরিষ্কার যে খোদ রাজধানী মস্কোতেও রাশিয়ার জেনারেলরা নিরাপদ নন।