রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ

পশ্চিমা ট্যাংক পোড়ানোর হুমকি

জার্মানির তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক। দেশটির কাছে এ ধরনের উন্নত ট্যাংক চাইছে ইউক্রেন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

জার্মানির কাছ থেকে লেপার্ড-২ ট্যাংক পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছে ইউক্রেন। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও কিয়েভকে আব্রামস ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বুধবার ক্রেমলিন বলেছে, পশ্চিমা দেশগুলো যদি ইউক্রেনকে ভারী ট্যাংক সরবরাহ করে, তবে তা যুদ্ধক্ষেত্রে ধ্বংস করা হবে।

ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘কারিগরি দিক থেকে এটা ব্যর্থ পরিকল্পনা। এটি ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে বাড়তি সুবিধা দেবে, এ রকম ধারণার অতিমূল্যায়ন। অন্য যুদ্ধ সরঞ্জামের মতো এই ট্যাংকও পোড়ানো হবে। পার্থক্য শুধু, এগুলো অত্যন্ত দামি।’

সিএনএন জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনভ গত মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি আব্রামস ট্যাংক ও অন্য ন্যাটো জোটের সামরিক সরঞ্জাম ইউক্রেনকে সরবরাহ করা হলে তা ধ্বংস করবেন রুশ সেনারা। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কিয়েভকে দিতে সম্মত হওয়া এম ১ আব্রামস ট্যাংক বিষয়ে আনাতোলি বলেন, ‘ওয়াশিংটনের কর্মকাণ্ডের পুরো ক্রম বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পুতুল সরকারকে সামরিক সহায়তার সীমা ক্রমাগত বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওয়াশিংটন ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের কৌশলগত পরাজয় ঘটাতে চাইছে, তা স্পষ্ট। ক্রিমিয়া আক্রমণের জন্য মার্কিন সহায়তার সবুজসংকেতও দেওয়া হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দনবাস, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন অঞ্চলের মানুষের বিরুদ্ধে মৌলবাদীদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধগুলোকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

ইউক্রেনে রাশিয়ার ট্যাংক

আনাতোলি আন্তোনভ আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে ট্যাংক সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিলে তাদের ‘প্রতিরক্ষামূলক অস্ত্র’ সম্পর্কে যুক্তি ব্যবহার করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। এটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরেকটি স্পষ্ট উসকানি হিসেবে দেখা হবে। বর্তমান সংঘাতে প্রকৃত আগ্রাসী কে, তা নিয়ে কারও ভ্রম থাকা উচিত নয়।

কিয়েভকে ট্যাংক সরবরাহের বিষয়ে জ্ঞাত মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেনে ৩০টি আব্রামস ট্যাংক পাঠানোর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে বাইডেন প্রশাসন। ক্রেমলিন মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো ইউক্রেনকে ট্যাংক দিলে দেশটিতে আরও দুর্দশা নেমে আসবে এবং এই মহাদেশে আরও বেশি উদ্বেগ তৈরি হবে। এই ট্যাংক দিয়ে রাশিয়ার লক্ষ্য অর্জনে কোনো বাধা দেওয়া সম্ভব হবে না।

এদিকে সরকারি সূত্রের বরাতে জার্মান সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে ইউক্রেনকে লেপার্ড-২ ট্যাংক দেওয়ার বিষয়ে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছেন জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি ছাড়াও কিয়েভকে ট্যাংক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড।

জার্মানির ট্যাংক পাঠানো নিয়ে পেসকভ সতর্ক করে বলেন, ইউক্রেনে ট্যাংক সরবরাহের বার্লিনের যেকোনো অনুমোদন অনিবার্যভাবে রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে, যা ইতিমধ্যেই নিম্নপর্যায়ে নেমে গেছে। এমন কার্যকলাপ ভবিষ্যতের জন্যও ভালো ইঙ্গিত নয়। বিষয়টির জের টানতে হবে।

যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়াকে প্রতিহত করতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ট্যাংকসহ ভারী অস্ত্র চেয়ে আসছিলেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তাঁর এই চাওয়ার প্রতি সাড়া দিয়ে ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ ইউক্রেনকে ট্যাংক দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সবার নজর এখন জার্মানির দিকে। জার্মানি এর আগে অবশ্য বলেছিল, পোল্যান্ডসহ ইউরোপের কোনো দেশ যদি জার্মানিতে তৈরি লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনের হাতে তুলে দেয়, সে ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না বার্লিন। যদিও এর আগে রোববার জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালিনা বায়েরবোক বলেছেন, যুদ্ধে সহায়তার জন্য পোল্যান্ড লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে পাঠাতে চাইলেও তাঁর সরকার বাধা দেবে না।

জার্মান অস্ত্র প্রস্তুতকারী কোম্পানি রাইনমেটাল জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে তারা ইউক্রেনে ১৩৯টি লেপার্ড যুদ্ধট্যাংক সরবরাহ করতে পারবে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোম্পানিটির একজন মুখপাত্র মিডিয়া গ্রুপ আরএনডিকে বলেন, রাইনমেটাল আগামী এপ্রিল-মে মাস নাগাদ ২৯টি লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউক্রেনে সরবরাহ করতে পারবে। আর ২০২৩ সালের শেষ বা ২০২৪ সালের শুরুর দিক নাগাদ তারা একই মডেলের আরও ২২টি ট্যাংক সরবরাহ করতে পারবে। এ ছাড়া কোম্পানিটি ৮৮টি পুরোনো লেপার্ড-১ ট্যাংকও ইউক্রেনে সরবরাহ করতে পারবে বলে জানানো হয়েছে। তবে সে ক্ষেত্রে কোনো সময়সীমা উল্লেখ করা হয়নি।

লেপার্ড-২ ট্যাংক হলো বিশ্বের প্রথম সারির যুদ্ধট্যাংকের একটি। জার্মানির সেনাবাহিনী এবং অনেক ইউরোপীয় দেশের সামরিক বাহিনী এই ট্যাংক ব্যবহার করে। ইউরোপীয় নয়, এমন দেশগুলোর মধ্যে কানাডা ও ইন্দোনেশিয়া এই ট্যাংক ব্যবহার করে। আফগানিস্তান, কসোভো ও সিরিয়ার সংঘাতে ডিজেল ইঞ্জিনচালিত এই যুদ্ধট্যাংকের ব্যবহার দেখেছে বিশ্ববাসী।

এই ট্যাংকের নানা বৈশিষ্ট্য আছে। ডিজাইনও বিভিন্ন রকমের হয়। এ ট্যাংকে নাইটভিশন ইকুইপমেন্ট এবং একটি লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার আছে, এর সাহায্যে লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব মাপা যায়। লেজার রেঞ্জ ফাইন্ডার রুক্ষ ভূখণ্ড বা রুক্ষ ভূমির ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় চলমান লক্ষ্যের ওপর ভালোভাবে নজরদারি করতে সাহায্য করে।

এ বিষয়ে ফিনিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের রিচার্স ফেলো মিন্না অ্যালান্ডার বলেন, লেপার্ড-২ ট্যাংক ইউরোপে রয়েছে। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এই ট্যাংক ব্যবহার করে আর এসব ট্যাংক সরবরাহের জন্য প্রস্তুত আছে। ইউক্রেনে এগুলো পাঠানো সহজ। রক্ষণাবেক্ষণও সহজ হবে। এগুলোর খুচরা যন্ত্রাংশও ইউরোপে আছে, তাই ইউক্রেনীয়দের প্রশিক্ষণ দেওয়া সহজ হবে।