ইউক্রেনের রাশিয়ার বিশেষ সামরিক অভিযানের দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে। যুদ্ধকালের এই সময়ে ব্যাপক বদল এসেছে রাশিয়ার চিত্রপটে। বদলেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও। অবশ্য এ বদলের ধারা শুরু হয়েছিল বেশ আগেই। নিজের অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির পাতা থেকে সেসব বিষয় তুলে ধরেছেন বিবিসির রাশিয়াবিষয়ক সম্পাদক স্টিভ রোজেনবার্গ।
রাশিয়ার সদ্য প্রয়াত বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির স্মৃতির প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছিলেন অনেকে। আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। সেখানে কথা হলো এক রুশ তরুণের সঙ্গে। কারাগারে নাভালনির মৃত্যু নিয়ে মনের কথাগুলো আমার কাছে তুলে ধরলেন তিনি। বললেন, ‘আমি ধাক্কা খেয়েছি। দুই বছর আগে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দিনও আমার একই অবস্থা হয়েছিল।’
ওই তরুণের কথাগুলো আমার মনে দাগ কেটেছিল। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর পর গত দুই বছরে রাশিয়ায় কী কী ঘটেছে, তা ভাবতে বসলাম। শেষ পর্যন্ত যে তালিকা তৈরি হলো, তা ছিল নাটকীয়তা, রক্তপাত ও শোকবহুল সব ঘটনায় পূর্ণ।
রাশিয়ার যুদ্ধ ইউক্রেনে মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞ বয়ে নিয়ে গেছে। রুশ সামরিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিটাও কম হয়নি। রাশিয়ার শহরগুলোতেও কামানের গোলা ও ড্রোন হামলা চালানো হয়েছে। দেশটির লাখো মানুষকে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর বড় ঘটনা ছিল, ভাড়াটে যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনারের বিদ্রোহ। এরপর এক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনায় নিহত হন ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন। এ ছাড়া ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগে পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। যুদ্ধের দুই বছরের মাথায় এসে এখন পুতিনের সবচেয়ে বড় সমালোচকের মৃত্যু হলো।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতিহাসের বাঁকবদলের একটি মুহূর্ত। যে পথ ধরে এ মুহূর্তের অবতারণা হয়েছে, তা-ও পরিষ্কার। ২০১৪ সালে ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া। ওই বছরেই পূর্ব ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে প্রথম সামরিক অভিযান চালায় মস্কো। এরপর ২০২০ সালে নাভালনির ওপর বিষ প্রয়োগ করা হয়। পরের বছর ২০২১ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর আগেও রাশিয়ায় দমন–পীড়ন চালাত সরকার। এখন তা বাড়ছে।
ভ্লাদিমির পুতিনের কথা বলতে গেলে যুদ্ধের এই দুই বছরে দেশে ও বিদেশে শত্রু দমনে তাঁকে দিন দিন আরও আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়সংকল্প মনে হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আর ইউক্রেন যুদ্ধকে পুরো পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরেছেন। পুতিনের ভাষ্য, এটা রাশিয়ার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই।
সম্প্রতি আমার বাসার আলমারিতে ২০ বছরের পুরোনো কিছু নথি পেয়েছিলাম। সে সময়টাতে ক্ষমতায় বসার শুরুর বছরগুলো পার করছিলেন পুতিন। ওই নথিগুলোতে ২০০১ সালের ১৭ মে আমি লিখেছিলাম, ‘সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ রুশ নাগরিক চান, রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিক।’ আর সে বছরের ২০ নভেম্বর আমার লেখা ছিল, ‘ন্যাটো ও রাশিয়া ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করতে চাইছে।’ তবে সবকিছু এখন কেন উল্টে গেল? বিষয়টি শুধু আমাকেই অবাক করেনি।
‘পুতিনের সঙ্গে যখন আমার দ্বিতীয়বারের মতো সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি খোলাখুলিভাবেই বলেছিলেন, “ন্যাটোতে যোগ দিতে কবে আপনারা রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানাবেন?’ জবাবে আমি বলেছিলাম, “আমরা কোনো দেশকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাই না, তারা আবেদন করে।”’লর্ড রবার্টসন, সাবেক প্রধান, ন্যাটো
কীভাবে ও কখন এর সমাপ্তি হবে? আমি ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারি না। যেটা পারি, তা হলো অতীতটা ঘেঁটে দেখা। সম্প্রতি আমার বাসার আলমারিতে ২০ বছরের পুরোনো কিছু নথি পেয়েছিলাম। সে সময়টাতে ক্ষমতায় বসার শুরুর বছরগুলো পার করছিলেন পুতিন। নথিগুলোর পাতা ওলটাতে ওলটাতে মনে হলো, আমি যেন যোজন যোজন দূরের ভিন্ন কোনো জগৎ সম্পর্কে পড়ছি।
ওই নথিগুলোতে ২০০১ সালের ১৭ মে আমি লিখেছিলাম, ‘সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৯ শতাংশ রুশ নাগরিক চান, রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিক।’ আর সে বছরের ২০ নভেম্বর আমার লেখা ছিল, ‘ন্যাটো ও রাশিয়া ঘনিষ্ঠভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করতে চাইছে।’ তবে সবকিছু এখন কেন উল্টে গেল? বিষয়টি শুধু আমাকেই অবাক করেনি।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে ন্যাটোর সাবেক প্রধান লর্ড রবার্টসনের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘২০০২ সালের মে মাসে মানুষটি (পুতিন) আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ইউক্রেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। নিজেদের নিরাপত্তা–সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো তারা নিজেরাই নেবে। এখন সেই মানুষই বলছেন, ইউক্রেন কোনো দেশই নয়।’
জবাবে ওই রুশ নারী বলেন, ‘আগে যেগুলো আমরা বাইরে থেকে আমদানি করতাম, সেগুলো এখন আমাদের কারখানাতেই তৈরি হচ্ছে। এটা ভালোই। তবে তরুণসহ যাঁরা নিহত হয়েছেন, সবার জন্য কষ্ট হয়। পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধের অবশ্যই কোনো দরকার নেই। নিজেদের জীবনে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই দেখেনি আমাদের লোকজন।’
পুতিন নাকি ন্যাটোতে রাশিয়ার যোগদানের বিষয়েও ভাবছিলেন। লর্ড রবার্টসন বলেছিলেন, ‘পুতিনের সঙ্গে যখন আমার দ্বিতীয়বারের মতো সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি খোলাখুলিভাবেই বলেছিলেন, “ন্যাটোতে যোগ দিতে কবে আপনারা রাশিয়াকে আমন্ত্রণ জানাবেন?’ জবাবে আমি বলেছিলাম, “আমরা কোনো দেশকে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানাই না, তারা আবেদন করে।” তখন পুতিন বলেছিলেন, “যে দেশগুলোকে আমরা গণনার মধ্যে ধরি না, তাদের সঙ্গে আমরা আবেদনে লাইনে থাকব না।”’
তবে পুতিন যে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আবেদন করবেন না, এমনটি আগে থেকেই মনে করতেন লর্ড রবার্টসন। লন্ডনে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘পুতিন চাইতেন যে ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার জন্য যেন তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। কারণ, তিনি সব সময় মনে করতেন এবং এখনো মনে করেন যে বিশ্বমঞ্চে রাশিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সোভিয়েত ইউনিয়ন যে সম্মান পেত, তা রাশিয়ারও পাওয়া উচিত।’
লর্ড রবার্টসনের মতে, একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পরাশক্তি হিসেবে ধরা হতো। তবে আজকের দিনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই অবস্থানের সঙ্গে নিজেদের মিলিয়ে কোনো দাবি করতে পারে না রাশিয়া।
ন্যাটোর সাবেক প্রধান বলেন, ‘আমি মনে করি, বর্তমানে (রাশিয়ার) এ অবস্থার জন্য কিছুটা দায়ী পুতিনের অহংবোধ। কিছু কিছু সময় পশ্চিমাদের দুর্বলতা, বিভিন্নভাবে পুতিনেরও উসকানির মুখে পড়া এবং তাঁর বাড়তে থাকা অহংবোধ মিলিয়ে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমার মতে, এ কারণেই একসময় ন্যাটোর দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে চাওয়া পুতিন এখন এই জোটকে হুমকি হিসেবে দেখেন।’
রুশ কর্মকর্তাদের দাবি, ইউরোপের পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণের কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাঁরা ক্রেমলিনকে দেওয়া ন্যাটোর একটি প্রতিশ্রুতি ভাঙার অভিযোগ তুলেছেন। বলা হয়ে থাকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষের দিনগুলোতে ন্যাটো বলেছিল, সোভিয়েতের অধীন থাকা দেশগুলোকে তাদের জোটভুক্ত করা হবে না।
লর্ড রবার্টসন বলেন, ‘এ নিয়ে কাগজে-কলমে কিছু লেখা নেই। এমন কোনো বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। কোনো চুক্তিও নেই। তবে পুতিন নিজেই ২০০২ সালের ২৮ মে রোম ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছিলেন। একই ঘোষণায় আমিও স্বাক্ষর করেছিলাম। ওই ঘোষণায় আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও অন্য কোনো দেশে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছিল। তাতে পুতিন স্বাক্ষর করেছিলেন। তিনি অন্য কাউকে দোষ দিতে পারেন না।’
মস্কো থেকে ৪০ মাইল দূরে সোলনেচনোগোরস্ক শহর। সেখানে একটি পার্কে রাশিয়ার গত দুই বছরের নানা ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। পার্কটিতে ভাগনারের সমর্থনে দেয়ালচিত্র রয়েছে। ফুল দেওয়া হয়েছে নাভালনির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। ওই পার্কে ইউক্রেন যুদ্ধে মারা যাওয়া রুশ সেনাদের একটি ভাস্কর্যও রয়েছে।
শহরের মাঝের দিকে গেলে একটি স্মৃতিস্তম্ভ পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আফগানিস্তান যুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে তৈরি করা হয়েছিল সেটি। তাতে নতুন করে ইউক্রেনে বিশেষ সামরিক অভিযানে নিহত সেনাদের কথাও স্মরণ করা হয়েছে। পাথরের ওপর খোদাই করে তুলে ধরা হয়েছে একে একে ৬৪টি নাম।
আমি যখন সেই স্মৃতিস্তম্ভের কাছে ছিলাম, তখন নাতিকে নিয়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন লিদিয়া পেত্রোভনা। জানতে চাইলাম, গত দুই বছরে তাঁর জীবন কীভাবে বদলেছে? জবাবে ওই নারী বলেন, ‘আগে যেগুলো আমরা বাইরে থেকে আমদানি করতাম, সেগুলো এখন আমাদের কারখানাতেই তৈরি হচ্ছে। এটা ভালোই। তবে তরুণসহ যাঁরা নিহত হয়েছেন, সবার জন্য কষ্ট হয়। পশ্চিমাদের সঙ্গে যুদ্ধের অবশ্যই কোনো দরকার নেই। নিজেদের জীবনে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছুই দেখেনি আমাদের লোকজন।’