রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে গ্যাস ব্যবহারের অভিযোগ তুলেছেন পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা। তবে বাস্তবতা হলো, বিশ্বব্যাপী গ্যাসের এ সংকটের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের নিজেদের নিষেধাজ্ঞাই দায়ী। রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে খুব সহজেই পশ্চিমারা এই জ্বালানি সংকট শেষ করে দিতে পারত। কিন্তু তা না করে এ সংকটের জন্য পুতিনের ওপর দোষ চাপাচ্ছেন পশ্চিমা নেতারা। আর এভাবে মিথ্যা প্রচার চালিয়ে তাঁরা বিশ্ববাসীকে বোকা বানাচ্ছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত করছেন।
রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা আরটির এক প্রতিবেদনে কলামিস্ট, রাজনৈতিক কৌশলবিদ, ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় পরিচালিত ভিন্নধারার টক শোর আয়োজক রাচেল মার্সডেন এমনটাই বলেছেন।
রাশিয়ার ব্যাংক, বৈদেশিক রিজার্ভসহ বাণিজ্যিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্র লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমারা। পশ্চিমারা রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বাদ দিয়েছে। এরপর আবার অভিযোগ তুলেছে, মস্কো গ্যাস রপ্তানির জন্য রুবলে মূল্য পরিশোধের শর্ত দিয়েছে।
এমন বক্তব্যের পক্ষে উদাহরণ হিসেবে একটি ঘটনা তুলে ধরেন মার্সডেন। বাস্তিল দিবসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ দেশটির নাগরিকদের পুরোপুরি রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া চলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন। একই সঙ্গে মাখোঁ যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে জ্বালানি ব্যবহারের অভিযোগ তোলেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে। মাখোঁর এই অভিযোগ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুরের প্রতিধ্বনি। রাচেল বলছেন, এ ধরনের বক্তব্য জ্বালানি সংকটের কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রকৃত কারণকে আড়াল করে দেয়। এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে এ সংকট ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজেদেরই তৈরি তা আড়ালে পড়ে যায়। আর এ খেলাই খেলে যাচ্ছে পশ্চিমা বিশ্ব।
গত এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন জ্বালানি নিয়ে রাশিয়া বিশ্বকে ব্ল্যাকমেল করছে বলে অভিযোগ ছুড়ে দেন। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি রুবলে মূল্য পরিশোধ করতে না পারার জন্য পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়ায় গ্যাস সরবরাহ স্থগিত করার ঘোষণার বিষয়টি তোলেন। রাশিয়ার গ্যাস উত্তোলন ও বিতরণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম এমন ঘোষণা দিয়েছিল।
রাচেল মার্সডেন বলছেন, সে সময় উরসুলা ভন ডের লিয়েন ও এখন মাখোঁ রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মুখ বন্ধ রেখেছেন। অথচ ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধের শুরু থেকেই এই নতজানু নীতিই গ্যাস সংকটের মূলে রয়েছে।
রাশিয়ার ব্যাংক, বৈদেশিক রিজার্ভসহ বাণিজ্যিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্র লক্ষ্য করে তড়িঘড়ি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমারা। পশ্চিমারা রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন-ব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বাদ দিয়েছে। এরপর আবার অভিযোগ তুলেছে, মস্কো গ্যাস রপ্তানির জন্য রুবলে মূল্য পরিশোধের শর্ত দিয়েছে।
রাচেল বলছেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন গ্যাস বন্ধ করতে ইইউকে বলেননি। বরং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিই বারবার রাশিয়ার জ্বালানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পশ্চিমা বিশ্বকে উসকে দিয়েছে। আর পশ্চিমারাও সে সুযোগ নিয়েছে। নিজ দেশের নাগরিকদের ক্ষতি করতে ও আরও বেপরোয়া হতে তারাও উসকে দিয়েছে জেলেনস্কিকে।
এর আরেকটি বড় উদাহরণ দিয়েছেন রাচেল। এ মাসের শুরুতে জেলেনস্কি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-১ মেরামতের জন্য সরঞ্জাম ফেরত না দিতে কানাডাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই পাইপলাইন দিয়ে রাশিয়া জার্মানিতে গ্যাস সরবরাহ করে। কানাডার বিরুদ্ধে এর আগে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছিল। এই পাইপলাইন ইউরোপীয় ইউনিয়নের শিল্পায়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে রক্ষণাবেক্ষণ বন্ধের বিষয়টি নিয়ে নেতাদের উদ্বেগও ছিল। এসব বিষয় বিবেচনা করে কানাডা সরঞ্জাম ফেরতে রাজি হলেও জেলেনস্কি বিষয়টি নিয়ে আবার ভাবতে বলেন।
রাচেল মার্সডন বলেন, সরঞ্জাম ফেরত দিতে রাজি হলেও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর কণ্ঠে পশ্চিমাদের সেই গৎবাঁধা মিথ্যা সুরেরই প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। ট্রুডোও রাশিয়ার বিরুদ্ধে গ্যাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার অভিযোগ তুলেছেন। অথচ বাস্তবে গ্যাসের এ সংকট তৈরি হয়েছে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে। আর গ্যাস সংকট নিয়ে এত নাটকের পেছনেও কলকাঠি নাড়ছে পশ্চিমারাই।
রাচেল মার্সডন ওই প্রতিবেদনে বলেন, যারা কিনতে চায়, তাদের কাছেই রাশিয়া জ্বালানি বিক্রি করে খুশি থাকতে চায়। যদি ইইউ নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বে জ্বালানির সংকট মিটে যাবে। কিন্তু পশ্চিমারা এ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া মানে তাদের ভুল স্বীকার করা। তাই পশ্চিমারা পুতিনের দোষ খুঁজছে। পশ্চিমা নেতারা এভাবে কেবল তাদের দেশের নাগরিকদেরই বোকা বানাচ্ছে না। তারা রাশিয়াকে একঘরে করতে দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি করছে। নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপনেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। তারা নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে এভাবে নিজেদেরই বোকা বানাচ্ছে।
জি-৭-ভুক্ত দেশগুলোও রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার জন্য দোষ দিচ্ছে। রাশিয়ার কাছে জবাবদিহি চাইছে।
এর আরেকটি বড় উদাহরণ দিয়েছেন রাচেল। এ মাসের শুরুতে জেলেনস্কি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় পাইপলাইন নর্ড স্ট্রিম-১ মেরামতের জন্য সরঞ্জাম ফেরত না দিতে কানাডাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন।
পশ্চিমারা রাশিয়াকে যতই একঘরে করতে চায়, বাস্তবতা হলো রাশিয়া ইউরোপ ও পশ্চিমের দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে বাকি বিশ্বের দিকে চোখ ফেরাতে পারে। আর দোষারোপের খেলা খেলতে খেলতে ইউরোপকে ভাবতে হবে, এ শীতে তারা কীভাবে ঘরবাড়ি গরম রাখবে অথবা শিশুদের কী খাওয়াবে।