দুই বছর আগে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে ইউক্রেন যেভাবে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তা চমক হয়ে দেখা গিয়েছিল অনেকের কাছে। ধারণা করা হচ্ছিল, পশ্চিমা দেশগুলোর অব্যাহত সমর্থনে ইউক্রেন বাহিনী রাশিয়াকে পিছু হটতে বাধ্য করবে। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। দেশটির পাঁচ ভাগের এক ভাগ ভূখণ্ড এখন রাশিয়ার দখলে। সর্বশেষ আভদিভকা শহর দখল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। যুদ্ধে এখন সুবিধাজনক অবস্থানে রাশিয়া।
যুদ্ধের দুই বছর পূর্তির প্রাক্কালে গতকাল শুক্রবার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনে যুদ্ধরত রুশ সেনাদের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, এই সেনারাই প্রকৃত বীর। তাঁরা সত্য ও ন্যায়ের জন্য লড়াই করছেন।
পুতিন সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা জানি, কাজটা আপনাদের জন্য কঠিন। আপনাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা যেন পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারেন, সে জন্য যা যা করা প্রয়োজন, তার সবকিছুই আমরা করব।’
অপর দিকে পশ্চিমা সহায়তা আটকে গিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকটে ভুগছে ইউক্রেন বাহিনী। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা মিত্রদের প্রতি দ্রুত সহায়তা পাঠানোর অনুরোধ জানাচ্ছেন। গোলাবারুদের ঘাটতির কারণে কয়েক জায়গায় পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন ইউক্রেনের সেনারা। এতে এই যুদ্ধের দুই বছর পূর্তির দিনে রণক্ষেত্রের যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে কিয়েভের জয়ের আশা অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে।
যুদ্ধের ময়দানের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলোর প্রবল চাপ সামলে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রেও পুতিন সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। ইউক্রেনে হামলা শুরু করার পর রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা দেয় পশ্চিমা দেশগুলো। আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, এতে ধসে পড়বে দেশটির অর্থনীতি। তবে ব্যবসার বিকল্প অংশীদার খুঁজে ধাক্কা সামলে নেয় মস্কো। ইউরোপ-আমেরিকায় তেল বিক্রি বন্ধ হলেও তা কয়েক গুণ বেড়ে যায় চীন, ভারতসহ কয়েকটি দেশে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র গতকাল রাশিয়ার পাঁচ শতাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেন করা চীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান, তুরস্ক, ভারত ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়ে গতকাল এক বিবৃতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, দুই বছর আগে পুতিন ইউক্রেনকে মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন। এসব নিষেধাজ্ঞা বিদেশে আগ্রাসন এবং দেশের ভেতরে নিপীড়ন চালানোর জন্য তার চরম মূল্য দেওয়া নিশ্চিত করবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) গতকাল রাশিয়ার প্রায় ২০০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের এক দল কর্মকর্তার রাশিয়ায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মস্কো।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী যখন ইউক্রেনে হামলা শুরু করে, তখন অনেকে ধারণা করেছিলেন, রাশিয়ার কিয়েভ দখল সময়ের ব্যাপার মাত্র। কিয়েভের উপকণ্ঠে চলেও এসেছিল রুশ বাহিনী। তবে ইউক্রেন বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর অবশ্য রাশিয়া দমে যায়নি। মস্কোপন্থী হিসেবে পরিচিত দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দেয় তারা।
ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়া এবং পূর্বাঞ্চলের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন পুতিন। পূর্বাঞ্চলীয় দনবাসের দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, বাখমুতসহ প্রায় পুরোটা এবং দক্ষিণাঞ্চলীয় জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের মেলিতোপোল, খেরসনসহ আশপাশের অঞ্চল এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে দোনেৎস্কের প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত আভদিভকা শহর দখলে নেয় রুশ বাহিনী। দোনেৎস্কের কাছে আরেক শহর কোস্তিয়ান্তিনিভকার নিয়ন্ত্রণ নিতে রুশ সেনারা ইউক্রেন বাহিনীর ওপর হামলা জোরদার করেছেন।
ইউক্রেন বাহিনী অবশ্য প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে গত বছর পাল্টা হামলা চালিয়ে পুরোপুরি সফল না হলেও কিছু এলাকা পুনরুদ্ধার করে তারা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তারা বাখুমতের কাছে ক্লিশচিভকা ও আন্দ্রিভকা শহর রুশ সেনাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে। তাদের হামলার মুখে খেরসনের একটি এলাকা থেকে পিছু হটে রুশ বাহিনী।
পশ্চিমাদের দেওয়া আধুনিক প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র কাজে লাগিয়ে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় একাধিকবার ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইউক্রেন। হামলা হয়েছে রাশিয়া থেকে ক্রিমিয়াকে সংযোগকারী কার্চ সেতুতে। কৃষ্ণসাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজেও হামলা চালিয়েছে তারা।
এই যুদ্ধে ঠিক কতসংখ্যক রুশ সেনা নিহত হয়েছেন, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। ইউক্রেন সেনাবাহিনীর তথ্যমতে, রাশিয়ার চার লাখের বেশি সেনা হতাহত হয়েছেন। তবে রাশিয়ার নাগরিকদের দ্বারা পরিচালিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যম মিডিয়াজোনার তথ্যমতে, ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার প্রায় ৪৫ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন। এই সংখ্যা আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর দশকব্যাপী যুদ্ধে যত সেনা নিহত হয়েছিলেন, তার তিন গুণ। এ ছাড়া রাশিয়ার ৪০ থেকে ৫৫ হাজার সেনা আহত হয়েছেন বলে মিডিয়াজোনা জানিয়েছে।
অপর দিকে যুদ্ধে ইউক্রেনের ৩ লাখ ৮৩ হাজার সেনা হতাহত হয়েছেন বলে গত বছর শেষে দাবি করেছিলেন রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু। তবে গত বছরের আগস্টে মার্কিন কর্মকর্তারা নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, যুদ্ধে ইউক্রেনের ৭০ হাজারের মতো সেনা নিহত এবং ১ লাখ ২০ হাজারের মতো সেনা আহত হয়েছেন।
সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, যুদ্ধ শুরুর পর রুশ বাহিনীকে কিছুটা অগোছালো মনে হলেও ২০২৩ সালে সেই অবস্থান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে তারা। সমরকৌশল, আক্রমণ পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রতিরক্ষা ও পাল্টা আক্রমণ—সবক্ষেত্রে রুশ বাহিনী এই সময়ে ব্যাপক উন্নতি করেছে। এতে ইউক্রেন বাহিনী তাদের কাছে অনেকটা কাবু হয়ে গেছে।
ইউক্রেন বাহিনীর বিরুদ্ধে এগিয়ে থাকার ক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর পক্ষে আরও একটি বিষয় কাজ করেছে। সেটি হলো পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র ও অর্থসহায়তার ক্ষেত্রে ভাটা পড়ে যাওয়া। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েক মাস ধরে চেষ্টা চালালেও ইউক্রেনের জন্য ছয় হাজার কোটি ডলারের নতুন সহায়তার বিষয়টি কংগ্রেসে পাস করাতে পারেননি।
ন্যাটোতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ইউক্রেনবিষয়ক মার্কিন দূত কার্ট ভলকান বলেছেন, ইউক্রেনের অর্থসহায়তার এ চাহিদা শেষ হওয়ার নয়। কারণ, এটা ছাড়া পরাশক্তি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারবে না তারা। নতুন অস্ত্র কিনে পাল্টা আক্রমণ চালাবে। কিন্ত কখনোই তারা তাদের হারানো ভূখণ্ড আর ফিরে পাবে না।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্যমতে, রাশিয়া হামলা করার পর বিভিন্ন সময় ইউক্রেনের ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যান। এই সংখ্যা দেশটির মোট জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ। তাঁদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এখন পর্যন্ত তাঁদের মধ্যে সাড়ে চার কোটি মানুষ নিজেদের ঘরে ফিরেছেন। বাকিরা এখনো বাস্তুচ্যুত।
ইউক্রেনে জাতিসংঘের মানবাধিকার মনিটরিং মিশনের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৫৮২ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার তথ্য তারা সংগ্রহ করেছে। এ ছাড়া ১৯ হাজার ৮৭৫ জন বেসামরিক নাগরিক আহত হয়েছেন। হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা।
এই যুদ্ধ লাখ লাখ বেসামরিক মানুষের জীবনে তীব্র দুর্দশা নিয়ে এসেছে বলে উল্লেখ করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক। বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, এই যুদ্ধের কোনো শেষ দেখা যাচ্ছে না।
ফলকার টুর্ক বলেন, যুদ্ধে বিস্তৃত পরিসরে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। এতে মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হচ্ছে। এই যুদ্ধের দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব প্রজন্মের পর প্রজন্মের ওপর পড়বে।