পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার। আজ শনিবার সকালে কার্যদিবস শুরু হয় তাঁর। ১৪ বছরের কানজারভেটিভ দলের শাসনের অবসান ঘটিয়ে তাঁর দলের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। প্রথম দিনেই নবনির্বাচিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে সভা করেন স্টারমার।
স্টারমারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী ও নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তাঁর নতুন মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন র্যাচেল রিভস। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে নিয়োগ পেয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ডেভিড ল্যামি।
নতুন সরকারে অ্যাঞ্জেলা রায়নারকে উপপ্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। যুক্তরাজ্যের নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন ইভেত্তে কুপার। জন হ্যালি প্রতিরক্ষামন্ত্রী, ব্রিজেত ফিলিপসন শিক্ষামন্ত্রী, এড মিলিব্যান্ড জ্বালানিমন্ত্রী, শাবানা মাহমুদ বিচারমন্ত্রী, জোনাথন রেনল্ড বাণিজ্যমন্ত্রী, লিজ কেন্ডাল শ্রম ও কারামন্ত্রী, স্টিভ রিড পরিবেশমন্ত্রী, পিটার কাইলি বিজ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী; লিসা নন্দী সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন। তাঁদের মধ্যে লিসা নন্দী ভারতীয় ও শাবানা মাহমুদ পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত।
যুক্তরাজ্যের নতুন মন্ত্রিসভায় কিছু চমকও দেখা গেছে। করোনা মহামারির সময়ে ব্রিটিশ সরকারের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করা প্যাট্রিক ভ্যালান্সকে বিজ্ঞানবিষয়ক মন্ত্রী করা হয়েছে। আর টিম্পসন গ্রুপের মালিক জেমস টিম্পসনকে কারামন্ত্রী করা হয়েছে।
এদিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ন্যাটোর ৭৫তম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেবেন স্টারমার। আগামী মঙ্গলবার ওয়াশিংটন ডিসিতে এ সম্মেলন শুরু হবে। এটি হবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্টারমারের প্রথম বিদেশ সফর। ওয়েস্টমিনস্টার এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ক্ষেত্রে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টোলটেনবার্গ বলেছেন, আগামী সপ্তাহে আবারও স্টারমারের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা করছেন। স্টারমারকে ন্যাটোর শক্ত সমর্থক হিসেবে উল্লেখ করেছেন স্টোলটেনবার্গ।
যুক্তরাজ্যে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত পার্লামেন্ট নির্বাচনে ৪১২টি আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। কনজারভেটিভ পার্টি পেয়েছে ১২১টি আসন। সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য কোনো দলের প্রয়োজন হয় ৩২৬ আসন। কনজারভেটিভ দলের নির্বাচনে ভরাডুবির পর পার্টির দলনেতার পদ ছেড়েছেন ঋষি সুনাক। লেবার পার্টির নেতা স্টারমার রাজার কাছে যাওয়ার আগেই বাকিংহাম প্যালেসে গিয়ে সরকারপ্রধানের পদ ছাড়েন সদ্য সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। এরপর ডাউনিং স্ট্রিটের বাইরে দেওয়া এক ভাষণে দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান তিনি।
শুক্রবার রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে দেখা করেন কিয়ার স্টারমার। ব্রিটেনের রাষ্ট্রপ্রধান রাজা তৃতীয় চার্লস তাঁকে যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। এর আগে বিজয় ভাষণে স্টারমার বলেন, ‘পরিবর্তনের শুরু হলো। আমরা বলেছিলাম, বিশৃঙ্খলায় ইতি টানব। সেটা করে দেখাব আমরা। আজ থেকে (যুক্তরাজ্যে) নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে।’
গতকাল মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে মন্ত্রীদের উদ্দেশে লেবার পার্টির নেতা বলেন, ‘আপনাদের অনেক কাজ করতে হবে। আমরা এখন এসব কাজ নিয়ে এগোব।’
দিনের শুরুর প্রথম ঘণ্টা স্টারমার ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগে কাটান।
সরকারে নিজের পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ মিশনের কথা জানিয়ে ৬১ বছর বয়সী এই নেতা বলেন, তিনি দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য পরিষেবাকে ঠিক করবেন। এ ছাড়া সীমান্ত নিরাপদ করাসহ সড়কে নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন।
কিন্তু স্টারমারের সামনে বড় বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। এগুলো হলো স্থবির অর্থনীতিকে সচল করা, সরকারি সেবাগুলোকে ঠিক করা ও দীর্ঘদিন ধরে মানুষের জীবনযাত্রার যে ব্যয় বেড়েছে, তাতে সামঞ্জস্য আনা ও আবাসস্থল সংকটের বিষয়টির সমাধান করা। স্টারমার বলেন, দেশে পরিবর্তন আনার বিষয়টি সুইচ টিপে ঠিক করার মতো নয়। পৃথিবী এখন আরও অস্থির স্থান হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি ঠিক করতে আরও সময় লাগবে।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় কিয়ার স্টারমারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন বিশ্বনেতারা। তিনি টেলিফোনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ ছাড়া তিনি ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও কথা বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে আগামী নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ওই নির্বাচনে বাইডেনের সঙ্গে লড়ছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে স্টারমারের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হবে তা নিয়ে নানা জল্পনাকল্পনা রয়েছে। কারণ, এর আগে ট্রাম্প স্টারমারকে ততটা গুরুত্ব দেননি। এর পরিবর্তে দেশটির ডানপন্থী নেতা নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকের প্রতি তাঁর সমর্থনের কথা জানিয়েছিলেন। দলটি এবার ১৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে ও পাঁচটি আসনে জিতেছে। অষ্টমবারের চেষ্টায় সংসদ সদস্য হয়েছেন নাইজেল ফারাজ। তবে লেবার পার্টির জয়ের কাছে এটা কিছুই নয়। ১৯৯৭ সালে টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে ৪১২ আসন পাওয়ার রেকর্ডও এবার ভেঙে গেছে। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভুগেছে কনজারভেটিভ পার্টি। ঋষি সুনাকের পরামর্শক উইলিয়াম হগ ইতিহাস বিচারে একে বিপর্যয়কর ফলাফল হিসেবে মন্তব্য করেন। এবারের নির্বাচনে ১২ জন সাবেক মন্ত্রী তাঁদের আসন হারিয়েছেন। পরাজিত তারকা প্রার্থীদের মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসও রয়েছে।
এবারের যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্র্যাটস দল দীর্ঘদিন পর বড় ধরনের অগ্রগতি অর্জন করেছে। দলটি ৭০টি আসন পেয়ে পার্লামেন্টের তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে উঠে এসেছে। কিন্তু স্বাধীনতার পক্ষের স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির জন্য এবারের নির্বাচনের ফল হতাশাজনক। দলটি ৪৮টি আসনের মধ্যে মাত্র ৯টি টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে নির্বাচনে ভালো করেছে গ্রিন পার্টি। দলটি একটি আসন থেকে চারটি আসন পেয়েছে। এবারের নির্বাচনে ছয়জন স্বতন্ত্র প্রার্থীও নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন মুসলিম জনবহুল এলাকায় লেবার পার্টির প্রার্থীকে হারিয়েছেন।
তবে লেবার পার্টির জন্য বড় ধরনের দুশ্চিন্তা কাজ করবে তাদের ভোট পাওয়ার হারে। দলটি মাত্র ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হিসাবে সর্বনিম্ন। এ ছাড়া এবার যুক্তরাজ্যে মাত্র ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছে, যা ২০০১ সালের পর সর্বনিম্ন।
জরিপকারী প্রতিষ্ঠানা সাভান্তার রাজনৈতিক গবেষক ক্রিস হপকিন্সের মতে, ভোট পড়ার হার লেবার পার্টির বিজয়ে কোনো ছায়া ফেলতে পারবে না। তবে লেবার পার্টিকে সামনে যে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে, এটি তার ইঙ্গিত করে। সহজ কথায়, তারা সম্ভবত ৪০ শতাংশের কম ভোট নিয়ে পরবর্তী নির্বাচনে ৪০০–এর বেশি এমপিকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।