পুতিন এখন কী করবেন এবং আরও চার প্রশ্ন

রুশ প্রেসিডেন্টে ভ্লাদিমির পুতিন ও ভাগনারপ্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিন
ফাইল ছবি: এএফপি

ভাড়াটে সেনা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ভাগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের বিদ্রোহ থেমে গেছে বলা যায়। মস্কো অভিমুখে তাঁর অভিযান বন্ধ হয়েছে। তিনি বেলারুশে যেতে সম্মত হয়েছেন। তবে এরপরও মস্কোয় যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তা বহাল রয়েছে। এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, তার অনেকগুলোরই উত্তর এখনো জানা যায়নি।

পুতিন কী আরও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবেন
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই সময়ের মধ্যে তেমন কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েননি তিনি। তবে ভাগনারের বিদ্রোহের পর পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মুখে পড়লেন তিনি। যদিও এই বিদ্রোহের ফলে প্রাথমিক যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল, তা মোকাবিলা করা গেছে। রুশ বিশ্লেষকেরা বলছেন, এ ঘটনায় পুতিন নিজেকে ততটা ক্ষমতাধর হিসেবে হাজির করেননি।

ভাগনারের বিদ্রোহের জেরে পুতিন গত শনিবার সকালে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, প্রিগোশিন বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এ ঘটনাকে পিঠে ছুরি চালানোর শামিল বলে আখ্যা দিয়েছেন।

সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মস্কোয় যে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, তা জারি রয়েছে। তবে পুতিন এখন কোথায় আছেন, তা জানা যাচ্ছে না। অনেকেই ধারণা করছেন, পুতিন এ ঘটনাকে দুভাবে মোকাবিলা করতে পারেন। তিনি হয়তো ইউক্রেনে হামলা জোরদার করবেন। নয়তো তিনি দেশের বিরুদ্ধে যাঁরা তাঁকে সমর্থন করছেন না, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন।

এ প্রসঙ্গে পোল্যান্ডের ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সদস্য রাদেক সিকোরস্কি বিবিসিকে বলেন, যাঁরা পুরোপুরি অনুগত নন, তাঁদের বিরুদ্ধে হয়তো ব্যবস্থা নেবেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। এর অর্থ এই, তিনি আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠবেন।

রোস্তভ-অন-দন শহরে ট্যাংকের ওপরে ভাগনার যোদ্ধারা। এই শহরটি দখল করে নিয়েছিল ভাগনার গ্রুপ। পরে মস্কো অভিমুখে অভিযান বন্ধ ঘোষণার পর শহর ছেড়ে চলে যান তাঁরা

বেলারুশে প্রিগোশিন কী করতে যাচ্ছেন
ভাগনারের এই বিদ্রোহের পেছনে রয়েছেন প্রিগোশিন। একজন স্বাধীন মানুষ তিনি। রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে বিদ্রোহ করেছিলেন। ব্যর্থ হয়েছেন। এই বিদ্রোহের কারণে তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। তবে ক্রেমলিন ও ভাগনার গ্রুপের মধ্যে ঠিক কী চুক্তি হয়েছে, তা আসলে জানা যায়নি।

রুশ বিশ্লেষকেরা এটা অন্তত প্রত্যাশা করছেন না, প্রিগোশিন খুব সহজেই একেবারে মিলিয়ে যাবেন না। কারণ, ভাড়াটে যোদ্ধাদের এই নেতা ইউক্রেন যুদ্ধে অংশ নেওয়া লাখো রুশদের জন্য কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট পুতিনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তিনি। তাঁর ছায়া হয়ে দীর্ঘদিন ছিলেন প্রিগোশিন।

প্রিগোশিন ক্রেমলিনের হয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছেন। সিরিয়া যুদ্ধে তিনি কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়া যখন ক্রিমিয়া দখল করে, তখনো কাজ করেছেন প্রিগোশিন। তবে অনেকেই মনে করছেন, এই যাত্রায় চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে প্রেসিডেন্ট পুতিনকে খানিকটা অপমানই করেছেন প্রিগোশিন। ফলে ভাগনারপ্রধানকে যে নিরাপত্তা নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে তিনি কী করবেন, সেই প্রশ্নের উত্তরও মিলছে না।

বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় প্রিগোশিনের সঙ্গে ক্রেমলিনের চুক্তি হয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা এখন প্রশ্ন তুলছেন, আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কো কতটুকু প্রিগোশিনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবেন, ভাগনার বাহিনী কী তাঁকে আর নেতা মানবে, এই বিদ্রোহের ঘটনা রাশিয়া, বেলারুশ ও ইউক্রেনের জন্য কতটুকু হুমকির।

রোস্তভ-অন-দন শহরের দখলের পর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন ভাগনার যোদ্ধারা

ভাগনার গ্রুপ এখন কী করবে
এই বিদ্রোহের আগে ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনের হয়ে কাজ করেছেন ভাগনার বাহিনীর হাজারো সেনা। স্বাধীনভাবে এই বাহিনী কাজ করেছে এত দিন। সেই সুযোগ শেষ হয়ে আসছে। প্রিগোশিন ও ভাগনার যোদ্ধাদের ওপর চাপ রয়েছে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীতে একীভূত হওয়ার। তবে দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে বিরোধ রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, সেই বিরোধ এবারের বিদ্রোহ উসকে দিয়েছে।

যাহোক, সেই বিদ্রোহ থেমে গেছে। প্রিগোশিন নির্বাসিত হচ্ছেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ভাগনার গ্রুপ এখন কী করবে?

ভাগনার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছিল, সেগুলো তুলে নেওয়া হয়েছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো ভিডিওতে দেখা গেছে, ভাগনার যোদ্ধারা রোস্তভ-অন-দন শহর ত্যাগ করছেন। তাঁরা সেখানকার সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণও ছেড়ে দিয়েছেন। তবে এটা এখনো পরিষ্কার নয়, ভাগনার যোদ্ধারা এখন রুশ সামরিক বাহিনীতে যুক্ত হবেন কি না এবং এ জন্য সহযোগিতা করবেন কি না। এ ছাড়া রাশিয়ার নিয়মিত বাহিনীর সেনারা এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের সহজভাবে গ্রহণ করবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তরও এখনো অজানা।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বলেছে, ভাগনার যোদ্ধারা ইউক্রেন যুদ্ধে ফিরে যাবে। এটা ঘটবে কি না, সেটাও প্রশ্ন। কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করছেন, প্রিগোশিন যদি বেলারুশে যান, তবে যোদ্ধারা তাঁকে অনুসরণ করে সেখানে যাবেন। আর সেখান থেকে কিয়েভে হামলা চালাতে পারেন তাঁরা।

রোস্তভ-অন-দন শহর দখলে নিয়েছিল ভাগনার বাহিনী। এক ভাগনার যোদ্ধাকে মোবাইল ফোনে কিছু একটা দেখাচ্ছিলেন এই তরুণী

ইউক্রেন যুদ্ধে এর প্রভাব কী
ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে অংশ নিয়েছে ভাগনার। পূর্ব ইউক্রেনের বাখমুতে লড়াইয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে এই বাহিনী। ইউক্রেনের বাহিনীকে বেশ ঘোল খাইয়েছে তারা। রাশিয়ার দাবি, ভাগনার যোদ্ধারা সরে যাওয়ায় ইউক্রেনে যে অভিযান চলছে, তাতে কোনো প্রভাব পড়বে না।

তবে যে যা-ই বলুক, ভাগনার যোদ্ধাদের সরে যাওয়ার কারণে রুশবাহিনী যে মনোবল হারাবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কয়েকজন বিশ্লেষক এমন ইঙ্গিতও দিয়েছেন, আগামী দিনগুলোয় রুশ বাহিনীর সঙ্গে এই বিদ্রোহীদের লড়াই হতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করছে প্রিগোশিন ও ভাগনার যোদ্ধাদের জন্য রাশিয়া কী নির্ধারণ করে রেখেছে, সেটার ওপর।

এদিকে এটাও ধারণা করা হচ্ছে, ভাগনার গ্রুপ সরে যাওয়ায় সীমান্তে যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, সেই সুযোগ নিয়ে রাশিয়া হামলা জোরদার করতে পারে ইউক্রেনে। আবার এটাও বলা হচ্ছে, সম্প্রতি বেদখল হয়ে যাওয়া এলাকা ফিরে পেতে অভিযান শুরু করেছে ইউক্রেন। ভাগনার গ্রুপের বিদ্রোহের কারণে রাশিয়া নিজ থেকে একটা সুযোগ করে দিয়েছে ইউক্রেনের বাহিনীর জন্য। এই সুযোগ নিতে পারে কিয়েভ।

এ প্রসঙ্গে ইউক্রেনে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিল টেলর বলেন, ভাগনার গ্রুপের বর্তমান কর্মকাণ্ডের কারণে রাশিয়ার দুর্বলতা সামনে এসেছে। ইউক্রেন বাহিনী এই সুযোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে এখন একটি ভালো অবস্থানে রয়েছে।

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর প্রবেশমুখে তৎপর রাশিয়ার সেনারা। শনিবার ভাগনার বাহিনীর মস্কো অভিমুখে অভিযান শুরুর পর সতর্ক অবস্থান নেয় রুশ বাহিনী

রাশিয়ার মানুষেরা কী ভাবছেন
ভাগনার গ্রুপের বিদ্রোহের পর প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভাষণ দিয়েছেন। এই ভাষণ থেকে এটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তিনি বিষয়টি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক তাতিয়ানা স্তানোভায় টেলিগ্রামে লিখেছেন, ভাগনার বিদ্রোহের জন্য রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই পুতিনকে দোষারোপ করবেন। তাঁরা পুতিনকে এ কারণে দোষারোপ করবেন এ জন্য যে তিনি সঠিক সময়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি। অর্থাৎ, এর মধ্য দিয়ে পুতিনের অবস্থানেই আঘাত লাগছে।

রাশিয়ার আপামর জনগণ কীভাবে বিষয়টিকে নিয়েছেন, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে ভাগনার বাহিনী বিদ্রোহ করে রাস্তায় নেমে আসার পর রাশিয়ার অনেক নাগরিকই তাঁদের বাহবা জানিয়েছেন। এটা রাশিয়ার নেতাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে।

ভাগনার যোদ্ধারা যে শহরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন, সেই শহরের মানুষেরা তাঁদের স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের জন্য হাততালি দিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা গেছে রুশদের।

আবার উল্টো চিত্রও কিছুটা দেখা গেছে। ভাগনার গ্রুপ শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর কিছু মানুষকে শহর ছেড়ে যেতেও দেখা গেছে।