অ্যাডলফ হিটলার
অ্যাডলফ হিটলার

চাপে পড়ে যে বইটি লিখতে হয়েছিল হিটলারকে

জার্মানির নাৎসি নেতা অ্যাডলফ হিটলার কারাবন্দী অবস্থায় লিখে ফেলেন আলোচিত বই ‘মেইন ক্যাম্প’ বা আমার সংগ্রাম। এই বইয়ের প্রথম খণ্ড ১৯২৫ সালের ১৮ জুলাই প্রকাশিত হয়। এই বই প্রকাশের পর আজ প্রায় ৯৯ বছর হতে চলল। জার্মানিতে দীর্ঘদিন এই বই ছাপা ও বিক্রি নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর বই নিয়ে আজকের আয়োজন।

১৯২৪ সালের ১ এপ্রিল লেখ্ নদীর তীরে ল্যান্ডসবার্গ দুর্গে অ্যাডলফ হিটলারের কারাবাসের দিন শুরু হয়। মিউনিখের গণ–আদালত তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। ফাঁসিও হতে পারত হিটলারের। কিন্তু আদালতের বিচারকদের তিনি মুগ্ধ করেন তাঁর প্রবল বাগ্মিতা দিয়ে। তাই সাজা একটু কম।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য হিটলারকে পাঁচ বছর কারাভোগ করতে হয়নি। সাকল্যে দশ মাস ভেতরে ছিলেন তিনি। বাড়তি সুবিধাও পেয়েছিলেন। সারাক্ষণ তাঁকে সেলের প্রকোষ্ঠে বন্দী থাকতে হতো না। দুর্গের বারান্দা ও বাগানে পায়চারি করার সুযোগ পেতেন।

কারাজীবন যেন নাৎসি নেতার শাপেবর হলো। কারণ, বিগত বছরগুলোতে বড় পরিশ্রম গেছে। বিশ্রামের সুযোগ বিন্দুমাত্র জোটেনি। হিটলারের মনে হলো, এটাই প্রকৃত সুযোগ তাঁর চিন্তা ও বিশ্বাসকে দুই মলাটে বন্দী করার। আর দলের অনেকেই তাঁকে এ রকম কিছু একটা করতে চাপ দিয়ে যাচ্ছিল।

হিটলার লেখা শুরু করলেন ‘মাইন ক্যাম্ফ’ যার ইংরেজি মাই স্ট্রাগল, বাংলায় ‘আমার সংগ্রাম’। তা ছাড়া কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে একজন শ্রুতলেখক পর্যন্ত দিল। হিটলারের খুব সুবিধা হলো। তিনি বলতে লাগলেন তাঁর শৈশব থেকে জমানো কথা আর টাইপ করতে থাকলেন সেই শ্রুতলেখক।

‘মাইন ক্যাম্ফ’–এর ভূমিকায় হিটলার লিখেছেন, ‘আমাদের সংগ্রামের পক্ষে এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান। আমাদের সংগ্রামটাকে কেবল এগিয়ে নেওয়া নয়, তাকে উন্নত করাও এই বইয়ের উদ্দেশ্য।’

হিটলারকে নিয়ে ইহুদি সাংবাদিকেরা যে ‘কল্পিত অপপ্রচার’ করেছেন, তার জবাব দেওয়ার সুযোগও এই বইয়ের মাধ্যমে হিটলার পেয়েছেন বলে লিখেছেন।

হিটলার লিখেছেন, ‘এই বই আমাকে দূরে সরিয়ে রাখবে না, বরং সংগ্রাম যাদের হৃদয়ের দাবি, তাদের কাছাকাছি আমাকে পৌঁছে দেবে। তাদের জ্ঞান বাড়াতে সাহায্য করবে।’

পরের লাইনেই আবার এই বইয়ের বার্তা কতসংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছাবে, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি, ‘আমি জানি যতটা লোককে মুখের কথায় কাজ করানো যায়, লেখার দ্বারা তা সম্ভব নয়। পৃথিবীতে প্রতিটি সৎ ও মহৎ সংগ্রাম সংগঠিত হয়েছে মহৎ বক্তার বক্তৃতা থেকে, কোনো বড় লেখকের লেখা থেকে নয়।’

তারপর অবশ্য লেখালেখির গুরুত্বে ফিরে এসেছেন হিটলার, ‘ভণিতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের দৃঢ় হাতিয়ার হিসেবে লেখাটাও প্রয়োজন। সুতরাং এই বইটি তার ভিত্তিপ্রস্তর।’

একটু পেছন ফেরা দরকার

‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইটির এই ছিল ভূমিকা। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আপাতত সামনে আর না এগিয়ে আমাদের একটু পেছন ফেরা দরকার।

আমরা জানি, জার্মানি আর ফ্রান্সের শত্রুতার ইতিহাস বহু পুরোনো। ফ্রান্সের শাসক নেপোলিয়ন বোনাপার্ট বহু যুদ্ধে জার্মানিকে হারিয়েছেন। অষ্টাদশ শতকে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে।

এমন ধারাবাহিকতায় আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল এক পক্ষে। আর জার্মানি ও তার মিত্ররা আরেক পক্ষে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির একধরনের পরাজয় ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টায় ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়, যা ভার্সাই চুক্তি নামে ইতিহাসে খ্যাত। এই চুক্তির ফলে এশিয়া-আফ্রিকাজুড়ে থাকা জার্মানির বিভিন্ন কলোনির নিয়ন্ত্রণ পায় যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স।

দিনে দিনে এই চুক্তির বিরুদ্ধে জার্মানিতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে। সৃষ্টি হতে থাকে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন।

এরই ধারাবাহিকতায় অস্ট্রিয়ায় ইন নদীর তীরে ছোট্ট গঞ্জশহর ব্রুনাউয়ে জন্ম নেওয়া খুবই সাধারণ পরিবারের সন্তান অ্যাডলফ হিটলার রাজনৈতিক দল গঠন করেন। ১৯২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, জার্মানির মিউনিখে বড় সমাবেশ হয়। সেখানে নিজের অনুসারীদের নিয়ে নাৎসিদের রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান লেবার পার্টি সংক্ষেপে নাৎসি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। এই পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। মূলত জার্মানিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল হিটলার ও তাঁর দলের লক্ষ্য। দল গঠনের সময় হিটলারের বয়স ছিল ৩১ বছর।

জার্মানিতে তখনকার সরকারে, রাজনীতিতে, বেসরকারি খাতে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইহুদিদের ব্যাপক দাপট ছিল। হিটলার কেন ইহুদিদের এতটা অপছন্দ করতেন, তা নিয়ে এত বছর পরেও গবেষণা চলছে।

দল গঠনের বছর তিনেকের মাথায় হিটলার ১৯২৩ সালের নভেম্বরে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বসলেন। কিন্তু অভ্যুত্থান সফল হলো না। নাৎসি দলের অনেকেই নিহত হলেন। গ্রেপ্তার হলেন হিটলারসহ বেশ কয়েকজন নেতা। ১৯২৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি মিউনিখের গণ–আদালতে হিটলার ও তাঁর সঙ্গীদের বিচারের রায় হলো। ফাঁসির দণ্ড হলো অনেকের। আগেই উল্লেখ করেছি, হিটলারের পাঁচ বছর কারাদণ্ড হলো। ল্যান্ডসবার্গের দুর্গে শুরু হলো তাঁর কারাজীবন। এখানেই তিনি ‘মাইন ক্যাম্ফ’ লেখা শুরু করলেন।

হিটলারের লেখা মেইন ক্যাম্প বই

‘মাইন ক্যাম্ফ’ প্রকাশিত

আজ থেকে ৯৯ বছর আগে আজকের দিনটিতে অর্থাৎ ১৯২৫ সালের ১৮ জুলাই প্রকাশিত হয়েছিল ‘মাইন ক্যাম্ফ’–এর প্রথম খণ্ড। মূলত হিটলার তাঁর জীবন, সংগ্রাম, রাজনীতি, রাজনৈতিক দল গঠন এবং ভবিষ্যৎ জার্মানির চেহারা কেমন হতে পারে, সেসব তুলে ধরেছেন প্রথম খণ্ডে। দ্বিতীয় খণ্ড প্রধানত নাৎসি দলের বিভিন্ন অনুশাসন–সংক্রান্ত। এটি প্রকাশিত হয়েছিল পরের বছরই। মূল ‘মাইন ক্যাম্ফ’–এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ৭২০।

হিটলার ‘মাইন ক্যাম্ফ’ উৎসর্গ করেছেন ১৯২৩ সালের সেই বিদ্রোহে, হিটলারের ভাষায় গণ–আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হন এবং মিউনিখ গণ–আদালতে যাঁদের ফাঁসি হয়, তাঁদের। উৎসর্গপত্রে তিনি নিহত ও ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত সবার নাম উল্লেখ করেছেন। লিখেছেন, ‘তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কর্মকর্তারা এই মৃত নায়কদের এক জায়গায় কবর দেওয়ার সুযোগটুকু দিতে অস্বীকার করে। সেই কারণে আমার লেখা বইটির প্রথম অংশ তাঁদের স্মৃতির প্রতি উৎসর্গ করলাম, যাতে সেই শহীদস্মৃতির চিরায়ত শক্তি আমাদের সংগ্রামী সৈনিকদের আলো দেখাতে পারে।’

হিটলার আশা করেছিলেন, তাঁর এই বইয়ের অনেক সংস্করণ প্রকাশিত হবে। এবং তিনি তাঁর আর্থিক ক্ষতির অনেকটাই এই বই থেকে প্রাপ্ত রয়্যালটি দিয়ে কাটিয়ে উঠবেন।

মজার বিষয় হলো, হিটলার বইটির নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘মিথ্যা, মূর্খতা ও কাপুরুষতার বিরুদ্ধে আমার সাড়ে চার বছরের সংগ্রাম’। কিন্তু বইটির প্রকাশক ফ্রাঞ্জ এহের ভারলাগের প্রধান ম্যাক্স অ্যামান নাৎসি নেতাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন, এত বড় নাম পাঠক নেবে না। আরও সংক্ষিপ্ত নাম চাই। মূলত এই ভদ্রলোকই ‘মাইন ক্যাম্ফ’ নামটি ঠিক করেন।

‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইটি প্রথম সম্পাদনা করেন এমিল মরিস, যিনি নাৎসি দলের প্রথম দিকের সদস্য এবং হিটলারের ব্যক্তিগত গাড়িচালক ছিলেন। এরপর বইটির মানোন্নয়নে হাত দেন হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস।

১৯২৫ সাল–পূর্ববর্তী জার্মানির গল্প

আমাদের মনে রাখতে হবে, হিটলারের নাৎসি দল জার্মানিতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ১৯৩০ সালে। এর তিন বছর পর (১৯৩৩) চ্যান্সেলর নিযুক্ত হন হিটলার। তিনি ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয় ১৯৪৫ সালে। আর ওই বছরের ৩০ এপ্রিল হিটলারের জীবন শেষ হয়। কীভাবে তাঁর মৃত্যু হলো, তা আমরা অনেকেই জানি। অতএব সে প্রসঙ্গে আর যাচ্ছি না।

তাহলে এটা স্পষ্ট যে বইটি ১৯২৫ সাল–পূর্ববর্তী জার্মানি তথা তৎকালীন ইউরোপের গল্প। তৎকালীন বিধ্বস্ত জার্মানি তথা ইউরোপের রোগগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে চরম বিশ্লেষণী ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন হিটলার এই বইয়ে। এই বই শুধু হিটলারের মানসিকতা বুঝতে সাহায্য করে না, তৎকালীন ভেঙে পড়া ইউরোপের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবিও এই বইয়ের আয়নায় ধরা পড়েছে।

পৃথিবীর প্রধান প্রধান সব ভাষায় অনূদিত হয়েছে ‘মাইন ক্যাম্ফ’। জার্মান অনেক শব্দেরই উপযুক্ত পরিভাষা অন্য ভাষাগুলোতে পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী অনুবাদকেরা তাই বাক্য ধরে সোজাসুজি অনুবাদ না করে হিটলারের বক্তব্যের মূল সুরটাকে বজায় রেখেছেন।

‘মাইন ক্যাম্ফ’ দীর্ঘ বই

এবার ‘মাইন ক্যাম্ফ’–এর গল্পে ফিরে যাই। বইটির একেবারে শুরুর দিকেই হিটলারের ‘হিটলারি চিন্তা’ প্রকাশ পেয়েছে। পররাজ্য দখল করার প্রতি তাঁর যে আগ্রহ, সে কথা জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘যখন জার্মানরা নিজেদের রাষ্ট্রের ফসলে নিজেদের উদর পূর্তি করতে পারবে না, তখনই অন্য রাষ্ট্রের দিকে হাত বাড়ানো উচিত। অবশ্যই লাঙলকে উল্টো করে তখন তরবারি হিসেবে তা ব্যবহার করতে হবে।’

হিটলারের বাবা একজন পোড় খাওয়া মানুষ। অনেক কষ্টেসৃষ্টে একটা সরকারি চাকরি জোগাড় করেছিলেন। ৬৫ বছর বয়সে অবসরে গিয়ে শুরু করেন কৃষিখামার। ভদ্রলোকের বই পড়ার অভ্যাস ছিল। তাঁর বেশির ভাগ বই ছিল মিলিটারি বিষয়সংক্রান্ত। এর মধ্যে একটি বই ছিল ফ্রাংকো-জার্মান যুদ্ধের (১৮৭০-৭১) ইতিহাস নিয়ে। এই বই পড়ে হিটলার জানতে পারলেন, সব জার্মান সে যুদ্ধে অংশ নেয়নি।

তাঁর কিশোর মনে প্রশ্ন, যারা অংশ নিল আর যারা নিল না, উভয় পক্ষ জার্মান হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনো ফারাক ছিল? আর যদি না থেকে থাকে, তাহলে সবাই কেন একই পতাকাতলে হাজির হলো না? সে যুদ্ধে তাঁর বাবাও অংশ নেননি। হিটলার লিখেছেন, ‘তাহলে কি আমরা, আর অন্যান্য জার্মান যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তারা এক নয়?’

হিটলার ১৫ বছর বয়সের আগেই প্রচণ্ড রকম জাতীয়তাবাদী হয়ে পড়েছিলেন। অজার্মান গান গাইতে আপত্তি করেন। অজার্মান শিক্ষকদের কাছে পড়তে সম্মত হননি। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে হিটলার ও তাঁর বন্ধুরা বড়দের হাতে তুলে দিতেন, যাতে এই সংগ্রাম আরও বেগবান করা যায়। এভাবে জীবনের স্বাদ পেয়ে যান হিটলার।

স্কুলে ইতিহাস পড়ানোর ধরন নিয়ে আপত্তি ছিল হিটলারের। তাঁর প্রশ্ন, কবে কোথায় যুদ্ধ হয়েছে, কোন মার্শাল কবে মারা গেছেন, কোন দিনে কার মাথায় রাজমুকুট চড়েছে, এসব খবরাখবর একটা জাতির ইতিহাসে কতটুকু মূল্য? হিটলারের মতে, ইতিহাসের অর্থ হলো কোন বিশেষ ঘটনা কেন, কীভাবে একটি জাতির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল, সেটা জানা। আর অদরকারি বিষয়কে ভুলে গিয়ে কেবল দরকারি জিনিসটা মনে রাখা।

হিটলারের মতে, প্রতিটি চিন্তাশীল লোকের রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রাথমিক কর্তব্য। যাদের পারিপার্শ্বিক জগৎটার রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান নেই, তাদের আলোচনা বা সমালোচনার কোনো অধিকারই নেই।

এ সময়ে হিটলার প্রচুর রাজনীতির বই পড়তেন। পড়তে পড়তে ভোর হয়ে যেত। তবে পড়াশোনা বলতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যা বোঝে, তাঁর কাছে তা ছিল অন্য। তিনি লিখেছেন, বইয়ের পর বই, পাতার পর পাতা পড়লেই তারা পাঠক নয়। যাদের মস্তিষ্কে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই, তারা পাঠক হয় কী করে?

একটা জায়গায় হিটলার লিখেছেন, ‘এই সময়ে আমি জাতির অস্তিত্বের পক্ষে দুটো বিপদ উপলব্ধি করতে পারি। এক হলো মার্ক্সিজম, আরেকটি হলো জুডোইজম বা ইহুদি ধর্মমত।’

১৯৪১ সালে রোমে কিং ভিক্টর ইমানুয়েল তৃতীয়, অ্যাডলপ হিটলার ও বেনিতো মুসোলিনি সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজ দেখছেন

বাবা-মায়ের মৃতুর পর হিটলার ভিয়েনায় চলে যান। ড্রাফটসম্যান ও জলরঙের অঙ্কনশিল্পী হিসেবে যা রোজগার করতেন, তাতে পেট ভরার মতো রুটি কিনতে পারতেন।

‘মাইন ক্যাম্ফ’ দীর্ঘ বই। বইটি শেষ হয়েছে হিটলারের দল গঠন (১৯২০ সালে) এবং প্রথম জনসভা (ওই বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি) আয়োজনের প্রস্তুতি এবং এ নিয়ে তাদের বিরোধী পক্ষের তৎপরতা নিয়ে। তখন সরকারে ছিল ন্যাশনাল পিপলস পার্টি। এদের সঙ্গে মার্ক্সবাদীদের আঁতাত ছিল। তাদের প্ররোচনায় পুলিশ রাস্তা থেকে হিটলারের দলের অনেক প্ল্যাকার্ড সরিয়ে নেয়।

সেদিন ছয় হাজার লোক হয়েছিল জনসভায়। প্রথম বক্তার পর দ্বিতীয় বক্তা হিসেবে বক্তব্য দেন হিটলার। তিনি মঞ্চে দাঁড়াতেই এক লোক হইচই শুরু করল। সভার লোক ধস্তাধস্তি করে তাঁকে বের করে দিল।

হিটলার লিখেছেন, ‘আমি বক্তৃতা দিতে লাগলাম আবেগের সঙ্গে। আমার আবেগময় বক্তৃতা এক উত্তপ্ত উত্তেজনার মধ্যে শ্রোতারা শুনতে লাগল। মনে হলো, তারা যেন নতুন বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে। চার ঘণ্টা পর উল্লসিত জনতা যখন সভাগৃহ ছেড়ে যেতে লাগল, তখন আমি বেশ বুঝতে পারলাম জার্মানিতে এক বিপ্লব সংঘটিত হতে চলেছে।’

বইয়ের শেষ লাইন দুটি এ রকম, ‘দেখতে দেখতে হলঘর শূন্য হয়ে গেল। তবু মনে হলো, বিপ্লবের অদৃশ্য রথ জয়যাত্রার পথে এগিয়ে চলেছে। ’

কপিরাইট ও বিক্রি

১৯৪৫ সালে হিটলারের আত্মহত্যার পর ‘মাইন ক্যাম্ফ’ বইয়ের কপিরাইট ব্যাভেরিয়ার রাজ্য সরকারের ওপর ন্যস্ত করা হয়। কিন্তু সেখানকার সরকার এই বইয়ের একটি কপিও জার্মানিতে প্রকাশ করতে সম্মত হয়নি। অবশেষে ২০১৬ সালে উঠে যায় ব্যাভেরিয়ান সরকারের কপিরাইটের মেয়াদ। তখন ১৯৪৫ সালের পর জার্মানিতে প্রথমবারের মতো পুনঃপ্রকাশিত হয় ‘মাইন ক্যাম্ফ’। এতে অবশ্য সেখানে বিতর্ক শুরু হয়। প্রতিবাদে সরব হয়ে ওঠে ইহুদিপন্থী গ্রুপগুলো।

অবশ্য সেই ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশের পর থেকেই ভানুয়াতু থেকে ভারত, বাংলাদেশ থেকে চিলি, সারা বিশ্বেই দেদার বিক্রি হচ্ছে ‘মাইন ক্যাম্ফ’।

ইতিহাসে তাঁর স্থান

অ্যাডলফ হিটলার বিশ্বের নিন্দিত লোকগুলোর একজন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সাড়ে ৫ কোটি মানুষের মৃত্যুর জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের অন্যতম তিনি। এর মধ্যে ৬০ লাখ ইহুদিকে তিনি গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছেন, ইতিহাসে যা হলোকাস্ট নামে পরিচিত। ৬০ লাখ সংখ্যাটি নিয়ে অবশ্য অনেকে প্রশ্ন তুলে থাকেন।

সার্বিকভাবে অ্যাডলফ হিটলার জার্মান জাতির মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে উল্টো তাদের অসম্মানিতই করেছেন, নিন্দিত করেছেন। তাই ইতিহাসে সারা জীবন নিন্দিত হয়েই থাকবেন তিনি।

(সূত্র: বিবিসিসহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও পরিতোষ মজুমদারের অনুবাদে ‘মাইন ক্যাম্ফ’)