রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর যুক্তরাজ্যের নতুন রাজা হয়েছেন তাঁর বড় ছেলে চার্লস। সিংহাসনে মায়ের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার অপেক্ষায় চার্লস কার্যত তাঁর পুরো জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। যদিও রানির বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাঁর অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য চার্লস পেয়েছেন।
ব্যক্তি হিসেবে নতুন ব্রিটিশ রাজা কেমন, তা নিয়ে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রয়াত রানির ৭৩ বছর বয়সী বড় ছেলে চার্লস সিংহাসনে আরোহণের পথে দীর্ঘ সময়ের উত্তরাধিকারী হিসেবে রেকর্ড গড়েছেন।
একবার চার্লস বলেছিলেন, ‘সমস্যাটা হলো এখানে কাজের কোনো বিবরণ নেই। তাই যদি এগিয়ে যেতে চাও, বরং নিজেই সেটা তৈরি করে নাও।’
একজন সহযোগী ২০০৬ সালে যুবরাজের বিষয়ে বলেন, ব্যক্তি হিসেবে অনেক বিষয়ে সক্রিয় ছিলেন চার্লস। যদিও সেটা পাদপ্রদীপের আড়ালেই ছিল। চার্লস নিজেকে একজন ভিন্নমতাবলম্বী হিসেবে দেখেন। তিনি বিদ্যমান রাজনৈতিক ঐকমত্যের বিরুদ্ধে কাজ করে আসছেন।
যুবরাজ হিসেবে তাঁর কাঁধে ছিল প্রত্যাশার বোঝা। আত্মসম্মান বোধ নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না বলে জীবনে তাঁকে কম ভুগতে হয়নি। তবে সঠিক কাজটি করার জন্য ছিল তাঁর বিরামহীন চেষ্টা।
চার্লস তাঁর মায়ের প্রজাদের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করাকে নিজের কর্তব্য হিসেবে দেখেছেন। মন থেকে যেসব বিষয়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করতেন, সেসব বিষয়ে ছিলেন স্পষ্টভাষী—বিশেষ করে স্থাপত্য, পরিবেশ, কৃষিকাজ, বিশ্বাস ও বিকল্প চিকিৎসা।
প্রায়ই যুবরাজের দৃষ্টিভঙ্গি খারিজ করে দেওয়া হয়। উদ্ভট বা ফ্যাশনেবল বলে উপহাস করা হয়। কিন্তু অন্যরা মনে করেন, তিনি বর্তমান চিন্তাধারা থেকে এগিয়ে আছেন।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও পরিবেশগত বিপর্যয় নিয়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সতর্ক করেছিলেন চার্লস। তিনি বলেছিলেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই ব্যবসা থেকে অর্জিত বিশ্বের সব অতিরিক্ত সম্পদ দিয়ে কী লাভ হবে, যদি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে এটিকে পুড়তে দেখা ছাড়া আপনি এর জন্য কিছুই করতে না পারেন।’
চার্লস ফিলিপ আর্থার জর্জ ১৯৪৮ সালের ১৪ নভেম্বর বাকিংহাম প্রাসাদে জন্মগ্রহণ করেন। সিংহাসনের উত্তরাধিকারের দিক থেকে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। দাদা রাজা ষষ্ঠ জর্জ ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মারা গেলে তিনি উত্তরাধিকারী হন এবং তাঁর মা হন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।
চার্লসের গৃহশিক্ষিকা ক্যাথরিন পিবলসের চোখে, বালক হিসেবে চার্লস অতি সংবেদনশীল, একাকী ও অত্যন্ত লাজুক ছিলেন। পড়াশোনা ও অঙ্কন ছিল তাঁর নীরব সাধনা।
১৯৫৮ সালে ৯ বছর বয়সে চার্লসকে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ ঘোষণা করা হয়েছিল। এমন ঘোষণার জন্য তিনি ছিলেন অপ্রস্তুত। এই পদবি ১৪ শতকের শুরু দিক থেকে দৃশ্যত সিংহাসনের উত্তরাধিকারীর জন্য সংরক্ষিত ছিল।
চার্লসকে ১৩ বছর বয়সে গর্ডনস্টউনে পাঠানো হয়। তাঁর বাবাও এই স্কটিশ বোর্ডিং স্কুলে পড়তেন। নিদারুণ একাকিত্বের কারণে তিনি স্কুলটিকে অপছন্দ করতেন। ওই স্কুলে কাটানো তাঁর সময়গুলোকে ‘পুরোপুরি নরক’, ‘কারাভোগ’ ও ‘বন্দিশিবিরের’ সঙ্গে তুলনা করেন যুবরাজ।
চার্লস অস্ট্রেলিয়ান গ্রামার স্কুলে ১৯৬৬ সালে পড়াশোনার সময়টুকু উপভোগ করেছেন। তিনি পরিপক্ব, বিকশিত ও স্বরূপে আবির্ভূত হন। চার্লস ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।
১৯৬৯ সালে কেরনারফন দুর্গে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ হিসেবে অভিষেক হওয়ার আগে এক মেয়াদে ওয়েলশ ভাষাও শিখেছিলেন চার্লস।
১৯৭১ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত রাজকীয় নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন চার্লস। তিনি যখন আট মাস ক্যারিবিয়ায় অবস্থান করছিলেন, তখন প্রেমিকা ক্যামিলা শ্যান্ড তাঁর পুরোনো প্রেমিক অ্যান্ড্রু পার্কার বোলসকে বিয়ে করেন। এতে চার্লস মর্মাহত হন।
একজন যোগ্য পাইলট হিসেবে ‘কাজের মানুষের’ ভাবমূর্তি অর্জন করেন চার্লস। সার্ফিং এবং বিমান থেকে লাফিয়ে পড়ায় তিনি ছিলেন দক্ষ।
অবসরের পর নৌবাহিনী থেকে পাওয়া ৭ হাজার ৪০০ পাউন্ড দিয়ে তিনি দাতব্য সংস্থা ‘প্রিন্স ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠা করেন। দাতব্য সংস্থাটি তার ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পর্যন্ত ৮ লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত তরুণকে একটি পেশা খুঁজে পেতে সহায়তা করেছে।
চার্লস বলেন, ‘আমি পুরোটা সময় বেড়ে উঠেছি অন্যদের নিয়ে ভাবতে। আমি সব সময় কাজটি সঠিকভাবে করার চেষ্টা করেছি এবং অন্যদের দিয়েও সঠিক কাজটি করিয়েছি।’
১৯৭০–এর দশকে চার্লসের জীবনে বহু প্রেমিকা এসেছে-গেছে। মাউন্টব্যাটেনের কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে চার্লস ১৯৭৯ সালে নিজের মেন্টরের নাতনি আমান্ডা ন্যাচবুলকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
এদিকে জীবনসঙ্গী খুঁজতে চার্লসের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। স্বল্প সময়ের রোমান্সের পর ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৯ বছর বয়সী ডায়ানা স্পেনসারকে প্রস্তাব দেন ৩২ বছর বয়সী যুবরাজ। লন্ডনের সেন্ট পল ক্যাথেড্রালে ২৯ জুলাই তাঁদের ‘রূপকথার বিয়ে’ সম্পন্ন হয়। ওই বিয়ের অনুষ্ঠান বিশ্বব্যাপী টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। এটি ছিল বিগত শতকের অন্যতম জমকালো রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান।
১৯৮২ সালে এই দম্পতির প্রথম ছেলে প্রিন্স উইলিয়াম এবং দুই বছর পর তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান প্রিন্স হ্যারির জন্ম হয়। ডায়ানার ওপর রাজকীয় দায়িত্বের চাপ বাড়তে থাকায় ইতিমধ্যেই তাঁদের দাম্পত্য জীবন নড়বড়ে হয়ে যায়।
দুজনই বিয়ের মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত হন। চার্লস পুরোনো প্রেমিকা ক্যামিলার সঙ্গে আবার সম্পর্কে জড়ান। প্রতিশোধ নিতে ডায়ানাও একই ধরনের সম্পর্কে জড়ান বলে ছয় মাস পর একটি বইতে ফাঁস হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৯২ সালের জুনে দুজন আলাদা হয়ে যান।
১৯৯৫ সালের নভেম্বরে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রীতিমতো বোমা ফাটান ডায়ানা। এরপর চার্লসের মা দুজনকে বিচ্ছেদের আহ্বান জানান। ১৯৯৬ সালের ২৮ আগস্ট দুজন বিচ্ছেদ সম্পন্ন করেন।
ডায়ানা ১৯৯৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহত হন। তখন চার্লস প্যারিস থেকে তাঁর মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। তাঁকে পূর্ণ রাজকীয় মর্যাদায় সমাহিত করার জন্য চাপ দেন।
শুরুর দিকে চার্লসের সঙ্গী হিসেবে ক্যামিলাকে আলোচনাতেই রাখতে চায়নি জনগণ। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলায়। জরিপে তাঁদের বিয়ের প্রতি সমর্থন বাড়তে থাকার বিষয়টি দেখা যায়। ২০০৫ সালে দুজনের বাগদান সম্পন্ন হয়। ওই বছরের ৯ এপ্রিল উইন্ডসর গিল্ডহলে সাধারণ আনুষ্ঠানিকতায় তাঁরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ক্যামিলা ‘ডাচেস অব কর্নওয়েল’ উপাধি পান।
এর পর থেকে চার্লসকে তাঁর ‘প্রিয় স্ত্রী’র পাশে দৃশ্যত সুখী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সময় কাটাতে দেখা যায়। তিনি দাদাও হয়েছেন।
চার্লস রাজা হলে ক্যামিলার পদবি কী হবে, সিংহাসনসংক্রান্ত বিষয়টি ২০২২ সালে সুরাহা করে দেন রানি। সে অনুযায়ী, চার্লস রাজা হওয়ায় ক্যামিলা এখন থেকে ‘কুইন কনসর্ট’।